লোকজন এখনো ভেবে পায় নাÑ তাকে কী নামে ডাকবে! পাগল, শয়তান, জালিম, ডাকাত,
অমানুষ, পশুÑ নাহ! কোনোটাই যেন তাকে মানায় না। এমনকি সমাজের সব গালি বা
মন্দ বাক্য দিয়ে যদি তাকে সম্বোধন করা হয় তবুও যেন পূর্ণতা পায় না তার
অপকর্মগুলো। ইতিহাসের এক মহাসন্ধিক্ষণে তিনি ছিলেন দুনিয়ার সবচেয়ে বড় রাজা।
সবচেয়ে নামী রাজবংশের রক্তের ধারক, তবুও তিনি ঘৃণিত-জঘন্যভাবে ঘৃণিত হয়ে
আসছেন যুগ থেকে যুগান্তরেÑ কাল থেকে কালান্তরেÑ শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে আজ
অবধি। তার হাজারো কুকর্ম তাকে হাজারো উপাধিতে ভূষিত করেছে; কিন্তু সবচেয়ে
সুন্দরতম উপাধি হলো পাগলা রাজা।
পাগলা রাজার মা যেন তার কুসন্তানের চেয়েও অনেক বেশি খারাপ। তাকেও লোকজন গালাগালি করে অশ্লীল ভাষায়Ñ চরিত্রহীনা, ডাইনি, কুত্তী, বেশ্যাÑ আরো কত কী! কিন্তু তার পরও মানুষের রাগ কমে না। আপনি যদি ভূমধ্যসাগরের দুই পাড়ের রাজ্যগুলোতে যান, তাহলে দেখতে পাবেন সেখানকার লোকেরা দুই হাজার বছর ধরে পাগলা রাজার মায়ের নাম ধরে গালিগালাজ করছে এবং অভিশাপ দিয়েছে। আপনি হয়তো বলবেন লোকজনের গালাগালিতে কী হয়? আমি বলবÑ হয়, অনেক কিছুই হয়! পাগলা রাজা ও তার মায়ের বংশের একজন লোকও পৃথিবীতে বেঁচে নেই, সম্পূর্ণভাবে নির্বংশ হয়েছে পাগলা রাজার গোষ্ঠী। অথচ পৃথিবীর তাবৎ রাজবংশের দুই-চারজন রক্তের ধারক সব সময় বেঁচে থাকে প্রাকৃতিক নিয়মেইÑ ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে।
এখন পাগলা রাজার যত্তসব নষ্টামী, ভ্রষ্টতা ও নিষ্ঠুরতার ইতিবৃত্ত বলব; কিন্তু তার আগে বলে নিই তার ডাইনি মায়ের কাহিনী। তিনি ছিলেন অসাধারণ সুন্দরী, বুদ্ধিমতী ও প্রচ রকম উচ্চাভিলাষী। তার বিকৃত যৌনাচার ও সীমাহীন কামুকতার কাহিনী রাজ্যময় বিস্তৃত ছিলÑ লোকজন সেসব কাহিনী বলাবলি করত আর ভদ্রজনেরা কানে আঙুল দিত অশ্লীল শব্দরাশি থেকে নিজেদের বাঁচানোর জন্য। চার চারটি বিয়ে এবং চারজন স্বামীকেই তিনি বিষ প্রয়োগে হত্যা করেছিলেন। সব শেষে তিনি লোভে পড়ে নিজের বয়োবৃদ্ধ চাচাকে বিয়ে করেছিলেন কেবল রাজ ক্ষমতা কুক্ষিগত করার জন্য। তার প্রতিদ্বন্দ্বী কত নারী ও পুরুষকে যে তিনি খুন করেছিলেন, তা কেউ বলতে পারবেন না। হতে পারে কয়েক শ’ কিংবা কয়েক হাজার। তরুণ ও যুবকদের প্রতি তার ছিল ভারি ঝোঁক। ধরে ধরে পছন্দমতো যুবকদের নিয়ে আসতেন আপন প্রাসাদেÑ তার পর ইচ্ছেমতো কামনা চরিতার্থ করতেন। সেসব হতভাগ্য যাতে কারো কাছে রানীমাতার অভিসারের কথা বলে দিতে না পারে সে জন্য তাদের গুম করে ফেলা হতো; কিভাবে গুম করা হতো তা আজো রহস্যাবৃত।
আমি যার কথা বলছি তার নাম ছিল এগ্রোপিনা। ১৫ খ্রিষ্টাব্দের ৭ নভেম্বর তিনি জন্মেছিলেন। আর মাত্র ৪৩ বছর বয়সে অর্থাৎ ৫৯ খ্রিষ্টাব্দের ২৩ মার্চ মারা গিয়েছিলেন। মারা গিয়েছিলেন মানে মেরে ফেলা হয়েছিল। বহু চেষ্টা-তদবির করে তিনি তার বৃদ্ধ চাচা যিনি ছিলেন সম্রাট, তাকে বিয়ে করলেন। তার পর ছলে-বলে-কৌশলে সিংহাসনের সব উত্তরাধিকারীকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিলেন। বৃদ্ধ সম্রাট কোনো উপায় না দেখে এগ্রোপিনার পূর্বতম স্বামীর ঔরসজাত সন্তানকেই সিংহাসনের উত্তরাধিকারী মনোনীত করলেন। এরপর শুরু হলো অন্য অধ্যায়Ñ এক রাতে দেখা গেল বৃদ্ধ সম্রাট মরে গেছেন আর পরদিন মহাসমারোহে পাগলা রাজা সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হলেন। এর কিছু দিন পর পাগলা রাজা নিজ হাতে তার মাকে হত্যা করে ফেললেনÑ সে এক লম্বা কাহিনী।
পাগলা রাজার মায়ের কাহিনী এবং নাম শোনার পরও হয়তো অনেকে রাজার নামটি ধরতে পারেননি। কিন্তু আমি নিশ্চিতÑ আমি যদি পাগলা রাজার নাম বলি তবে এক কথায় সবাই তাকে চিনতে পারবেন। দুনিয়াতে তার মতো কুকর্ম কেউ করেননি; এমনকি ফেরাউনও নয়। ফেরাউনের বড় দোষÑ সে নিজেকে খোদা দাবি করেছিল। পাগলা রাজাও নিজেকে খোদা দাবি করেছিলেন। পার্থক্য হলো কথিত ফেরাউন দ্বিতীয় রামেসিস আদতে ছিলেন একজন মহাবীর, মহাজ্ঞানী এবং যুদ্ধজয়ী সুশাসক; মিসরবাসী এখনো তাকে মহান রামিসিস বা রামেসিস দ্য গ্রেট বলে ডাকেন। অন্য দিকে পাগলা রাজার অত্যাচারে রাজ্যময় লোক অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। তার জুলুম আর পাগলামিতে আল্লাহর জমিনের মাশরেক থেকে মাগরিব পর্যন্ত তাবৎ ভূখণ্ডের অধিবাসী অভিশাপ বর্ষণ করতে থাকে। ফলে আসমান থেকে নেমে আসে একের পর এক বিপর্যয়। পাগলা রাজার স্বপ্নের প্রাসাদ ভেঙে চুরমার হয়ে যায়Ñ আল্লাহর গজবে তিনি মৃত্যুবরণ করার জন্য চিৎকার করতে থাকেন। পাত্র-মিত্র, চাকর-বাকর সবার হাত-পা ধরতে থাকেন এবং সবাইকে তলোয়ার দিয়ে তাকে হত্যা করার জন্য আকুতি জানাতে থাকেন। কেউ যখন তার অনুরোধে সাড়া দিলেন না, তখনই তিনি পৃথিবীর সেই বিখ্যাত উক্তিটি করেনÑ তবে কি আমার কোনো বন্ধু নেই যে আমার অনুরোধে আমাকে জীবন যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দেয়ার জন্য আমাকে মেরে ফেলতে পারে; কিংবা আমার কি তাহলে কোনো শত্রুও নেই যে কিনা বিুব্ধ হয়ে আমাকে মেরে ফেলতে পারে?
এবার আমি পাগলা রাজার নামটি বলে মূল কাহিনীটি শুরু করি। তার নাম নিরো। পুরো নাম নিরো কডিয়াস সিজার। ‘রোম যখন পুড়ছিল, নিরো তখন বাঁশি বাজাচ্ছিল’Ñ ঐতিহাসিক সেই উপকথাটির নায়ক তিনি। রোমান সাম্রাজ্যের সম্রাট পদে অভিষিক্ত হয়েছিলেন ১৩ অক্টোবর ৫৪ খ্রিষ্টাব্দেÑ যখন তার বয়স ছিল মাত্র ১৭ বছর। রাজত্ব করেছিলেন মোট ১৪ বছর। ৩০ বছর বয়সে অর্থাৎ ৬৮ সালের ৯ জুন রাতে নিজ হাতে নিজের গলায় ছুরি চালিয়ে আত্মহত্যা করার মাধ্যমে এক দিকে যেমন নিজের জীবনের সমাপ্তি ঘটান, অন্য দিকে মহান পূর্বপুরুষ জুলিয়ার্স সিজার প্রতিষ্ঠিত রাজবংশ এবং কডিয়াস সিজার অগাস্টাস সাম্রাজ্যের প্রায় এক শ’ বছরের পুরনো শাসনামলেরও পরিসমাপ্তি ঘটে। তার কুকর্মের অভিশাপে দুনিয়ার কোথাও মহান জুলিয়ার্স সিজারের রক্তের কোনো ধারক খুঁজে পাওয়া যাবে নাÑ এ যেন প্রকৃতির এক দুরন্ত প্রতিশোধ, যা শিক্ষণীয় হয়ে থাকে যুগ-যুগান্তরের অত্যাচারী শাসকদের জন্যÑ যদি তারা আসলেই কিছু শিখতে চায়।
নিরোর চরিত্রের বদ জিনিসগুলো মূলত তার মায়ের চরিত্র থেকে সংক্রমিত হতে থাকে। শিশু নিরো দেখত তার মা দিবানিশি তার বাবাকে অত্যাচার করছে। প্রাসাদের মধ্যেই একের পর এক অপকর্ম করে বেড়াচ্ছে। বিশেষ করে মায়ের যৌনাচারের বিকৃত অভিব্যক্তি নিরোকে শৈশবকাল থেকে নিজ জীবনের প্রতি বীতশ্রদ্ধ করে তোলে। তার শরীরে যৌবনের ছোঁয়া লাগামাত্রই সে নিজেকে নিয়ে মেতে ওঠে ভ্রষ্টাচারে। রক্ত সম্পর্কে তার দাদা ও মায়ের বিয়ের কারণে হঠাৎ দাদা থেকে বাবা হয়ে যাওয়া সম্রাট কডিয়াসও ছিলেন বিকৃত রুচির মানুষ। ফলে নিরোর পক্ষে কোনো অপকর্ম করতে নীতিনৈতিকতার কোনো বাধা ছিল না প্রাসাদের ভেতরে কিংবা বাইরে।
কিশোর নিরো সাঙ্গপাঙ্গসহ রোম নগরীতে ঘুরে বেড়াত এবং ইচ্ছেমতো যার-তার ঘরে ঢুকে পড়ত। পছন্দমতো কোনো মেয়ে পেলে তো কথাই নেই। নিজের ভ্রষ্টতার স্বাক্ষর রেখে আসত সেসব পরিবারের চাপা কান্নার উপযুক্ত জবাব হিসেবে। সারা রোমে তার বিরুদ্ধে ছিঃ ছিঃ রব উঠল। তার মা এগ্রোপিনা ছেলের কুকর্ম কমানোর জন্য অল্প বয়সে তার বিয়ের ব্যবস্থা করলেন। কিন্তু তাতে হিতে বিপরীত হলো। তার কামনা বাসনা দিনকে দিন বাড়তে থাকল। প্রথম স্ত্রী কডিয়া অক্টাভিয়া ছিলেন সম্রাট কডিয়াসের মেয়ে রীতিমতো রোমান রাজরক্তের ধারক। সম্পর্কে নিরোর সৎ বোন; কিন্তু দুশ্চরিত্র নিরো প্রথমে এক ক্রীতদাসীর প্রেমে পড়েন, যার নাম কডিয়া এসিটি। তার পর পপ্পিয়া সাবিনা নামের এক বিবাহিত মহিলার প্রেমে পড়েন এবং একসময় তাকে দ্বিতীয় স্ত্রী হিসেবে বিয়েও করেন। শুধু কি তাই, মেসালিনা ও স্পারস নামের অন্য দুই মহিলাকেও বিয়ে করেন। ফলে অতি অল্প বয়সেই তার বউয়ের সংখ্যা দাঁড়াল চার-এ। তবে অবাক করা বিষয় হলো তার চার নম্বর বউ স্পারস কিন্তু মেয়ে ছিলেন না। তিনি ছিলেন অনিন্দ্য সুন্দর এক বালক ক্রীতদাস। ৬৭ খ্রি. সম্রাট নিরো তাকে বিয়ে করেন সমকামিতার জন্য।
৫৪ খ্রিষ্টাব্দে নিরো সুবিশাল রোমান সাম্রাজ্যের সম্রাট হন। আজকের দুনিয়ার বলতে গেলে সমগ্র ইউরোপ, উত্তর আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য ও ভূমধ্যসাগরের কিছু গুরুত্বপূর্ণ দ্বীপ নিয়ে তার সুবিশাল সাম্রাজ্য ছিল বলে ধনে-জ্ঞানে এবং খ্যাতিতে ছিলেন দুনিয়ার শীর্ষস্থানে। এই রাজ্য পরিচালনার জন্য পাত্র-মিত্র, উজির, নাজির ও সেনাপতি ছাড়াও ছিল শক্তিশালী সিনেট বা সংসদ। নিরোর বয়স যদিও মাত্র ১৭ বছর ছিল তথাপি তিনি ছিলেন অনেক দিক থেকেই দক্ষ এবং অতিমাত্রায় আত্মমর্যাদাশীল। সিনেটের একজন প্রভাবশালী সদস্য ছাড়াও তার দু’জন গুরুত্বপূর্ণ উপদেষ্টা ছিলেন লুসিয়াস ও বুররাস নামে। অন্য দিকে তার মা এগ্রোপিনার প্রভাব তো ছিলই।
সম্রাট নিরো কারো পরামর্শ বা কর্তৃত্ব মেনে নিতে নারাজ। বিশেষ করে তার মায়ের সাথে সম্পর্কের চরম অবনতি হলো। তার মা যখন ছেলের দাম্পত্য জীবনে নাক গলাতে আরম্ভ করলেন, তখনই পরিস্থিতি চলে গেল আয়ত্তের বাইরে। নিরোর প্রথম স্ত্রী অক্টাভিয়া ছিলেন রাজকুমারী। ফলে তিনি নতুন সম্রাটের ভ্রষ্টতা মেনে নিতে পারেননি। সম্রাট তাকে রাজ্য থেকে বের করে একটি নির্জন দ্বীপে নির্বাসনে পাঠান। এ নিয়ে রাজ পরিবার ও অভিজাত মহলে দারুণ প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। সম্রাট কয়েকজন অভিজাত নাগরিককে হত্যা করেন এবং একসময় নিজের মাকেও মেরে ফেলেন।
ক্ষমতা লাভের পাঁচ বছরের মাথায় সম্রাট নিরো অনেকটা অর্ধ উন্মাদের মতো হয়ে যান। বিরোধী মতামত একদম সহ্য করতে পারতেন না। যাকে ইচ্ছে তাকে শাস্তি দিতেন আবার যাকে ইচ্ছে তাকে মেরেও ফেলতেন। সাম্রাজ্যের অভিজাতবর্গকে রাতের আঁধারে ধরে এনে গুম করে ফেলতেন। হঠাৎ করেই তিনি আবিষ্কার করলেন সিনেটে সম্ভবত তাকে নিয়ে চক্রান্ত হচ্ছে। তিনি বিরোধীদলীয় সিনেটেরদের ধরে আনলেন এবং নিজে দাঁড়িয়ে থেকে প্রায় এক শ’ প্রভাবশালী, বয়োজ্যেষ্ঠ এবং রোমান সাম্রাজ্যের কীর্তিমান রাজনীতিবিদদের হত্যা করলেন। এরপর সাম্রাজ্য বিরোধীমুক্ত হয়েছে বলে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলতে লাগলেন।
৬০ সালের পর সম্রাটের বোধ হয় মস্তিষ্ক বিকৃতি ঘটল। তিনি রাত-বিরাত ঘর থেকে বের হন। প্রকাশ্য রাজপথে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে প্রস্রাব করা, গান করা কিংবা চিৎকার করে ভিক্ষা করার মতো নি¤œমানের কাজকর্ম করতে থাকেন। এ সময় তিনি নিজেকে খোদা বলে দাবি করেন। শুধু তা-ই নয়, তিনি বলতে থাকেনÑ ‘এই পৃথিবীতে খোদা বলে যদি কেউ থেকে থাকে তবে সেই খোদার দরকার আছে তার সাহায্য গ্রহণের; কিন্তু তার কোনো দরকার নেই কোনো খোদার সাহায্য।’ তিনি রাস্তাঘাটে চলতে ফিরতে গিয়ে হঠাৎ দাঁড়িয়ে যেতেন, তার পর কোনো পথচারীকে ধরে বলতেনÑ এই তুমি গান করছ কেন? আমাকে নিয়ে ব্যঙ্গ করে গান গাওয়া হচ্ছে? দাঁড়াও দেখাচ্ছি মজা! Ñ এ কথা বলেই তিনি তার সাথে থাকা প্রহরীদের নির্দেশ দিতেন ওই পথচারীর শিরñেদ করার জন্য। পথচারীর মস্তক দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যখন রাজপথের ধুলায় লুটিয়ে পড়ত, তখন সম্রাট নিরো অদ্ভূত এক পৈশাচিক অট্টহাসিতে ফেটে পড়তেন।
তিনি রাজপ্রাসাদে প্রায়ই শাহী ভোজে রোমের অভিজাতবর্গকে পিঠে-পায়েসসহ নানা রকম রাজভোগ খাওয়ানোর জন্য দাওয়াত করতেন। লোকজন এলে তিনি নিজে গান গাইতেন ও নাচতেন। রাজ্যের সম্মানিত বয়স্ক লোকদেরও গান গাইতে এবং নাচতে নির্দেশ দিতেন। তারা যখন সম্রাটের হুকুম পালন করতেন তখন তিনি বুড়োদের বেসুরো গান এবং ধ্যাতাং ধ্যাতাং নাচ দেখে খিলখিলিয়ে ও পিকপিকিয়ে হাসতেন। এর ক’দিন পর তিনি রাজপ্রাসাদ ত্যাগ করে টাইবার নদীর তীরবর্তী একটি রাজকীয় ফলের বাগানে গিয়ে উঠলেন। সেখানে তাঁবু টানিয়ে তিনি প্রিয় স্ত্রী সাবিনাকে নিয়ে থাকতেন। সাবিনার প্রতি নির্দেশ ছিল সম্পূর্ণ বিবস্ত্র হয়ে পালঙ্কের ওপর শুয়ে থাকা। সম্রাট উলঙ্গ স্ত্রীর শরীরের ওপর হালকা একটি চাদর দিয়ে আচ্ছাদনের ব্যবস্থা করতেন। চাদরটি ছিল অতিশয় পাতলা ও মসৃণ, যার ফাঁক দিয়ে সম্রাজ্ঞীর শরীর দেখা যেত। এরপর তিনি সেই তাঁবুর মধ্যে সাক্ষাৎপ্রার্থীদের ডাকতেন। কেউ যদি ভুলক্রমে সম্রাজ্ঞীর উলঙ্গ শরীরের দিকে তাকাতেন তাহলে আর রক্ষা ছিল নাÑ নির্ঘাত মরতে হতো।
এভাবেই সম্রাট নিরোর পাগলামি চলছিল। সম্রাটের পাগলামির শিকার হয়ে পুরো রোমবাসী পাগল হওয়ার উপক্রম হলেন। তার ক্ষমতা লাভের ১০ বছরের মাথায় তিনি ঘটিয়ে ফেললেন ইতিহাসের সবচেয়ে বড় দানবীয় ঘটনা। ’৬৪ সালের ১৮ জুলাই তিনি রোম নগরীতে আগুন ধরিয়ে দিলেন। নগরীর সবচেয়ে বড় বিপণিবিতান সার্কাস মাক্সিমাসে আগুনের সূত্রপাত হলো। ১৯ জুলাই রাত পর্যন্ত মোট ৪৮ ঘণ্টা ধরে রোম নগরী পুড়ে ছারখার হয়ে গেল। কেউ বলে তিনি বাঁশি বাজাচ্ছিলেন আবার কেউ বলে ভায়োলিন।
রোম নগরীর সেই আগুন নিয়ে বহু কথাÑ বহু উপকথা প্রচলিত। কেউ বলেন, রোমের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে লোকজন যখন রোমিউলাসের নাম উচ্চারণ করতেন তখন সম্রাট নিরোর শরীরে হিংসের আগুন জ্বলে উঠত। তিনি চাইতেন নতুন একটি শহর নির্মাণ করে ইতিহাসের মাইলফলক হিসেবে চিহ্নিত হতে। আবার অন্যরা বলেন, রোম নগরীর পুরনো বাড়িঘর ও অলিগলি তার একদম পছন্দ হতো না। তাই তো তিনি পুরনো নগরী জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ছারখার করে নতুন একটি শহর গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন নিজের নাম ও যশকে কৃতীময় করার জন্য।
আগুনে ভস্মীভূত হওয়ার দু-এক মাসের মধ্যেই নিরো নতুন নগরী নির্মাণের কাজে হাত দিলেন। প্রায় ১০ বর্গমাইল এলাকাজুড়ে তৈরি হতে থাকল নতুন ও অত্যাধুনিক শহর। সাম্রাজ্যের বিভিন্ন স্থান থেকে রাতারাতি সংগ্রহ করা হতো কোটি কোটি টন মার্বেল, গ্রানাইডসহ অন্যান্য মূল্যবান পাথর। জড়ো করা হলো লাখ লাখ ক্রীতদাসকে। চলতে থাকল নতুন শহর নির্মাণের কাজ। দিন-রাত ২৪ ঘণ্টা কাজ চলেÑ আর পাগলা সম্রাট একটি ঘোড়ায় চড়ে সেই দৃশ্য দেখেন এবং ভায়োলিন বাজিয়ে গান করেন। এ কাজ করতে করতে তার রাজকোষের সব অর্থভাণ্ডার শেষ হলে গেল। সেনাবাহিনীর বেতনভাতা আটকা পড়ার উপক্রম হলো; কিন্তু তখনো বাকি ছিল সম্রাটের দৃষ্টিতে নতুন দু’টি স্থাপনার নির্মাণ। একটি হলো নিজের জন্য বিলাসবহুল প্রাসাদ আর অন্যটি হলো ৩০ মিটার উচ্চতাবিশিষ্ট তার নিজের একটি ভাস্কর্য।
সম্রাটের অর্থমন্ত্রী অনেক বোঝালেন অর্থসঙ্কটের কথা; কিন্তু পাগলা সম্রাটের জিদÑ না, করতেই হবে ৩০০ একর জায়গার ওপর ‘ডোমাস আউরিয়া’ নামের প্রাসাদ এবং ৩০ মিটার উচ্চতাবিশিষ্ট ভাস্কর্য নির্মাণে ব্যয় ধরা হলো ৩০০ কোটি স্বর্ণমুদ্রা। টাকা কোথায়? পাগলা রাজা হুকুম দিলেন ট্যাক্স বাড়াও এবং রাজ্যের ধনীদের ধন লুট করো। হুকুম তামিল হলো এবং এক দিনের মধ্যে অর্থ সংগ্রহ হয়ে গেল; কিন্তু রাজ্যে দেখা দিলো ভয়াবহ অরাজকতা ও বিদ্রোহ। সম্রাট কঠোরহস্তে বিদ্রোহ দমনের চেষ্টা করলেন। ফলে রোম বিদ্রোহমুক্ত হলো বটে; কিন্তু প্রদেশগুলোতে অশান্তি ছড়িয়ে পড়ল। এভাবে চলল ৬৮ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত। ইতোমধ্যে সম্রাটের শহর, প্রাসাদ ও ভাস্কর্য নির্মাণের কাজ শেষ হলো। সম্রাট ৬৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে মহা ধুমধামে নতুন প্রাসাদে উঠলেন।
মার্চ মাসে গাল্লিয়া প্রদেশের গভর্নর গাইয়াস জুনিয়াস সম্রাটের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করলেন অতিরিক্ত কর আরোপের অভিযোগ তুলে। সম্রাট স্বয়ং যুদ্ধের ময়দানে উপস্থিত হলেন। পরিস্থিতি তার প্রতিকূলে চলে যাওয়ায় তিনি রোমে পালিয়ে এলেন। তিনি দুপুরের দিকে তার প্রাসাদে ফিরে ঘুমিয়ে পড়লেন। মাঝ রাতে জেগে দেখেন প্রাসাদের সব রক্ষী পালিয়ে চলে গেছে। এরপর তিনি প্রাসাদের বিভিন্ন কক্ষে অবস্থানরত তার বন্ধু-বান্ধবদের খোঁজ করলেন। দেখলেন কেউ নেইÑ সবাই তাকে ছেড়ে পালিয়েছে। এরপর তিনি চিৎকার করে বললেনÑ কেউ কি আছো যে আমাকে তার তলোয়ার দিয়ে হত্যা করতে পারে। প্রাসাদ বেদিতে তার আর্তচিৎকার প্রতিধ্বনিত হলো; কিন্তু কেউ এলো না।
সম্রাট পাগলের মতো প্রাসাদ থেকে দৌড়ে বের হয়ে এলেন গভীর রাতে। তারই প্রতিষ্ঠিত শহরের অলিগলিতে চিৎকার করলেন। কেউ তার জন্য দরজা খুলল না। ইতোমধ্যে তার চারজন বিশ্বস্ত চাকর ও বালক স্ত্রী স্পারস এগিয়ে এলেন। সম্রাট তাদের কবর খোঁড়ার জন্য নির্দেশ দিলেন। এমন সময় সম্রাটের কাছে খবর এলোÑ রোমান সিনেট তাকে গণশত্রু আখ্যা দিয়ে গ্রেফতারের নির্দেশ দিয়েছে। এ খবর শুনে নিজেকে আর স্থির রাখতে পারলেন না। নিজের চাকু দিয়ে নিজের গলার রগ কেটে আত্মহত্যা করলেন। মৃত্যুর সময় উচ্চারণ করলেন সেই বিখ্যাত বাণীÑ ‘কুয়ালিস আর্টিফেক্স পিরিও’। ইংরেজিতে যার অর্থ দাঁড়ায়Ñ "What an artist dies in me." তারিখটি আবার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছিÑ ৬৮ সালের ৯ জুন, সময় ভোররাত। স্থান : রাজপথ।
পাগলা রাজার মা যেন তার কুসন্তানের চেয়েও অনেক বেশি খারাপ। তাকেও লোকজন গালাগালি করে অশ্লীল ভাষায়Ñ চরিত্রহীনা, ডাইনি, কুত্তী, বেশ্যাÑ আরো কত কী! কিন্তু তার পরও মানুষের রাগ কমে না। আপনি যদি ভূমধ্যসাগরের দুই পাড়ের রাজ্যগুলোতে যান, তাহলে দেখতে পাবেন সেখানকার লোকেরা দুই হাজার বছর ধরে পাগলা রাজার মায়ের নাম ধরে গালিগালাজ করছে এবং অভিশাপ দিয়েছে। আপনি হয়তো বলবেন লোকজনের গালাগালিতে কী হয়? আমি বলবÑ হয়, অনেক কিছুই হয়! পাগলা রাজা ও তার মায়ের বংশের একজন লোকও পৃথিবীতে বেঁচে নেই, সম্পূর্ণভাবে নির্বংশ হয়েছে পাগলা রাজার গোষ্ঠী। অথচ পৃথিবীর তাবৎ রাজবংশের দুই-চারজন রক্তের ধারক সব সময় বেঁচে থাকে প্রাকৃতিক নিয়মেইÑ ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে।
এখন পাগলা রাজার যত্তসব নষ্টামী, ভ্রষ্টতা ও নিষ্ঠুরতার ইতিবৃত্ত বলব; কিন্তু তার আগে বলে নিই তার ডাইনি মায়ের কাহিনী। তিনি ছিলেন অসাধারণ সুন্দরী, বুদ্ধিমতী ও প্রচ রকম উচ্চাভিলাষী। তার বিকৃত যৌনাচার ও সীমাহীন কামুকতার কাহিনী রাজ্যময় বিস্তৃত ছিলÑ লোকজন সেসব কাহিনী বলাবলি করত আর ভদ্রজনেরা কানে আঙুল দিত অশ্লীল শব্দরাশি থেকে নিজেদের বাঁচানোর জন্য। চার চারটি বিয়ে এবং চারজন স্বামীকেই তিনি বিষ প্রয়োগে হত্যা করেছিলেন। সব শেষে তিনি লোভে পড়ে নিজের বয়োবৃদ্ধ চাচাকে বিয়ে করেছিলেন কেবল রাজ ক্ষমতা কুক্ষিগত করার জন্য। তার প্রতিদ্বন্দ্বী কত নারী ও পুরুষকে যে তিনি খুন করেছিলেন, তা কেউ বলতে পারবেন না। হতে পারে কয়েক শ’ কিংবা কয়েক হাজার। তরুণ ও যুবকদের প্রতি তার ছিল ভারি ঝোঁক। ধরে ধরে পছন্দমতো যুবকদের নিয়ে আসতেন আপন প্রাসাদেÑ তার পর ইচ্ছেমতো কামনা চরিতার্থ করতেন। সেসব হতভাগ্য যাতে কারো কাছে রানীমাতার অভিসারের কথা বলে দিতে না পারে সে জন্য তাদের গুম করে ফেলা হতো; কিভাবে গুম করা হতো তা আজো রহস্যাবৃত।
আমি যার কথা বলছি তার নাম ছিল এগ্রোপিনা। ১৫ খ্রিষ্টাব্দের ৭ নভেম্বর তিনি জন্মেছিলেন। আর মাত্র ৪৩ বছর বয়সে অর্থাৎ ৫৯ খ্রিষ্টাব্দের ২৩ মার্চ মারা গিয়েছিলেন। মারা গিয়েছিলেন মানে মেরে ফেলা হয়েছিল। বহু চেষ্টা-তদবির করে তিনি তার বৃদ্ধ চাচা যিনি ছিলেন সম্রাট, তাকে বিয়ে করলেন। তার পর ছলে-বলে-কৌশলে সিংহাসনের সব উত্তরাধিকারীকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিলেন। বৃদ্ধ সম্রাট কোনো উপায় না দেখে এগ্রোপিনার পূর্বতম স্বামীর ঔরসজাত সন্তানকেই সিংহাসনের উত্তরাধিকারী মনোনীত করলেন। এরপর শুরু হলো অন্য অধ্যায়Ñ এক রাতে দেখা গেল বৃদ্ধ সম্রাট মরে গেছেন আর পরদিন মহাসমারোহে পাগলা রাজা সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হলেন। এর কিছু দিন পর পাগলা রাজা নিজ হাতে তার মাকে হত্যা করে ফেললেনÑ সে এক লম্বা কাহিনী।
পাগলা রাজার মায়ের কাহিনী এবং নাম শোনার পরও হয়তো অনেকে রাজার নামটি ধরতে পারেননি। কিন্তু আমি নিশ্চিতÑ আমি যদি পাগলা রাজার নাম বলি তবে এক কথায় সবাই তাকে চিনতে পারবেন। দুনিয়াতে তার মতো কুকর্ম কেউ করেননি; এমনকি ফেরাউনও নয়। ফেরাউনের বড় দোষÑ সে নিজেকে খোদা দাবি করেছিল। পাগলা রাজাও নিজেকে খোদা দাবি করেছিলেন। পার্থক্য হলো কথিত ফেরাউন দ্বিতীয় রামেসিস আদতে ছিলেন একজন মহাবীর, মহাজ্ঞানী এবং যুদ্ধজয়ী সুশাসক; মিসরবাসী এখনো তাকে মহান রামিসিস বা রামেসিস দ্য গ্রেট বলে ডাকেন। অন্য দিকে পাগলা রাজার অত্যাচারে রাজ্যময় লোক অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। তার জুলুম আর পাগলামিতে আল্লাহর জমিনের মাশরেক থেকে মাগরিব পর্যন্ত তাবৎ ভূখণ্ডের অধিবাসী অভিশাপ বর্ষণ করতে থাকে। ফলে আসমান থেকে নেমে আসে একের পর এক বিপর্যয়। পাগলা রাজার স্বপ্নের প্রাসাদ ভেঙে চুরমার হয়ে যায়Ñ আল্লাহর গজবে তিনি মৃত্যুবরণ করার জন্য চিৎকার করতে থাকেন। পাত্র-মিত্র, চাকর-বাকর সবার হাত-পা ধরতে থাকেন এবং সবাইকে তলোয়ার দিয়ে তাকে হত্যা করার জন্য আকুতি জানাতে থাকেন। কেউ যখন তার অনুরোধে সাড়া দিলেন না, তখনই তিনি পৃথিবীর সেই বিখ্যাত উক্তিটি করেনÑ তবে কি আমার কোনো বন্ধু নেই যে আমার অনুরোধে আমাকে জীবন যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দেয়ার জন্য আমাকে মেরে ফেলতে পারে; কিংবা আমার কি তাহলে কোনো শত্রুও নেই যে কিনা বিুব্ধ হয়ে আমাকে মেরে ফেলতে পারে?
এবার আমি পাগলা রাজার নামটি বলে মূল কাহিনীটি শুরু করি। তার নাম নিরো। পুরো নাম নিরো কডিয়াস সিজার। ‘রোম যখন পুড়ছিল, নিরো তখন বাঁশি বাজাচ্ছিল’Ñ ঐতিহাসিক সেই উপকথাটির নায়ক তিনি। রোমান সাম্রাজ্যের সম্রাট পদে অভিষিক্ত হয়েছিলেন ১৩ অক্টোবর ৫৪ খ্রিষ্টাব্দেÑ যখন তার বয়স ছিল মাত্র ১৭ বছর। রাজত্ব করেছিলেন মোট ১৪ বছর। ৩০ বছর বয়সে অর্থাৎ ৬৮ সালের ৯ জুন রাতে নিজ হাতে নিজের গলায় ছুরি চালিয়ে আত্মহত্যা করার মাধ্যমে এক দিকে যেমন নিজের জীবনের সমাপ্তি ঘটান, অন্য দিকে মহান পূর্বপুরুষ জুলিয়ার্স সিজার প্রতিষ্ঠিত রাজবংশ এবং কডিয়াস সিজার অগাস্টাস সাম্রাজ্যের প্রায় এক শ’ বছরের পুরনো শাসনামলেরও পরিসমাপ্তি ঘটে। তার কুকর্মের অভিশাপে দুনিয়ার কোথাও মহান জুলিয়ার্স সিজারের রক্তের কোনো ধারক খুঁজে পাওয়া যাবে নাÑ এ যেন প্রকৃতির এক দুরন্ত প্রতিশোধ, যা শিক্ষণীয় হয়ে থাকে যুগ-যুগান্তরের অত্যাচারী শাসকদের জন্যÑ যদি তারা আসলেই কিছু শিখতে চায়।
নিরোর চরিত্রের বদ জিনিসগুলো মূলত তার মায়ের চরিত্র থেকে সংক্রমিত হতে থাকে। শিশু নিরো দেখত তার মা দিবানিশি তার বাবাকে অত্যাচার করছে। প্রাসাদের মধ্যেই একের পর এক অপকর্ম করে বেড়াচ্ছে। বিশেষ করে মায়ের যৌনাচারের বিকৃত অভিব্যক্তি নিরোকে শৈশবকাল থেকে নিজ জীবনের প্রতি বীতশ্রদ্ধ করে তোলে। তার শরীরে যৌবনের ছোঁয়া লাগামাত্রই সে নিজেকে নিয়ে মেতে ওঠে ভ্রষ্টাচারে। রক্ত সম্পর্কে তার দাদা ও মায়ের বিয়ের কারণে হঠাৎ দাদা থেকে বাবা হয়ে যাওয়া সম্রাট কডিয়াসও ছিলেন বিকৃত রুচির মানুষ। ফলে নিরোর পক্ষে কোনো অপকর্ম করতে নীতিনৈতিকতার কোনো বাধা ছিল না প্রাসাদের ভেতরে কিংবা বাইরে।
কিশোর নিরো সাঙ্গপাঙ্গসহ রোম নগরীতে ঘুরে বেড়াত এবং ইচ্ছেমতো যার-তার ঘরে ঢুকে পড়ত। পছন্দমতো কোনো মেয়ে পেলে তো কথাই নেই। নিজের ভ্রষ্টতার স্বাক্ষর রেখে আসত সেসব পরিবারের চাপা কান্নার উপযুক্ত জবাব হিসেবে। সারা রোমে তার বিরুদ্ধে ছিঃ ছিঃ রব উঠল। তার মা এগ্রোপিনা ছেলের কুকর্ম কমানোর জন্য অল্প বয়সে তার বিয়ের ব্যবস্থা করলেন। কিন্তু তাতে হিতে বিপরীত হলো। তার কামনা বাসনা দিনকে দিন বাড়তে থাকল। প্রথম স্ত্রী কডিয়া অক্টাভিয়া ছিলেন সম্রাট কডিয়াসের মেয়ে রীতিমতো রোমান রাজরক্তের ধারক। সম্পর্কে নিরোর সৎ বোন; কিন্তু দুশ্চরিত্র নিরো প্রথমে এক ক্রীতদাসীর প্রেমে পড়েন, যার নাম কডিয়া এসিটি। তার পর পপ্পিয়া সাবিনা নামের এক বিবাহিত মহিলার প্রেমে পড়েন এবং একসময় তাকে দ্বিতীয় স্ত্রী হিসেবে বিয়েও করেন। শুধু কি তাই, মেসালিনা ও স্পারস নামের অন্য দুই মহিলাকেও বিয়ে করেন। ফলে অতি অল্প বয়সেই তার বউয়ের সংখ্যা দাঁড়াল চার-এ। তবে অবাক করা বিষয় হলো তার চার নম্বর বউ স্পারস কিন্তু মেয়ে ছিলেন না। তিনি ছিলেন অনিন্দ্য সুন্দর এক বালক ক্রীতদাস। ৬৭ খ্রি. সম্রাট নিরো তাকে বিয়ে করেন সমকামিতার জন্য।
৫৪ খ্রিষ্টাব্দে নিরো সুবিশাল রোমান সাম্রাজ্যের সম্রাট হন। আজকের দুনিয়ার বলতে গেলে সমগ্র ইউরোপ, উত্তর আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য ও ভূমধ্যসাগরের কিছু গুরুত্বপূর্ণ দ্বীপ নিয়ে তার সুবিশাল সাম্রাজ্য ছিল বলে ধনে-জ্ঞানে এবং খ্যাতিতে ছিলেন দুনিয়ার শীর্ষস্থানে। এই রাজ্য পরিচালনার জন্য পাত্র-মিত্র, উজির, নাজির ও সেনাপতি ছাড়াও ছিল শক্তিশালী সিনেট বা সংসদ। নিরোর বয়স যদিও মাত্র ১৭ বছর ছিল তথাপি তিনি ছিলেন অনেক দিক থেকেই দক্ষ এবং অতিমাত্রায় আত্মমর্যাদাশীল। সিনেটের একজন প্রভাবশালী সদস্য ছাড়াও তার দু’জন গুরুত্বপূর্ণ উপদেষ্টা ছিলেন লুসিয়াস ও বুররাস নামে। অন্য দিকে তার মা এগ্রোপিনার প্রভাব তো ছিলই।
সম্রাট নিরো কারো পরামর্শ বা কর্তৃত্ব মেনে নিতে নারাজ। বিশেষ করে তার মায়ের সাথে সম্পর্কের চরম অবনতি হলো। তার মা যখন ছেলের দাম্পত্য জীবনে নাক গলাতে আরম্ভ করলেন, তখনই পরিস্থিতি চলে গেল আয়ত্তের বাইরে। নিরোর প্রথম স্ত্রী অক্টাভিয়া ছিলেন রাজকুমারী। ফলে তিনি নতুন সম্রাটের ভ্রষ্টতা মেনে নিতে পারেননি। সম্রাট তাকে রাজ্য থেকে বের করে একটি নির্জন দ্বীপে নির্বাসনে পাঠান। এ নিয়ে রাজ পরিবার ও অভিজাত মহলে দারুণ প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। সম্রাট কয়েকজন অভিজাত নাগরিককে হত্যা করেন এবং একসময় নিজের মাকেও মেরে ফেলেন।
ক্ষমতা লাভের পাঁচ বছরের মাথায় সম্রাট নিরো অনেকটা অর্ধ উন্মাদের মতো হয়ে যান। বিরোধী মতামত একদম সহ্য করতে পারতেন না। যাকে ইচ্ছে তাকে শাস্তি দিতেন আবার যাকে ইচ্ছে তাকে মেরেও ফেলতেন। সাম্রাজ্যের অভিজাতবর্গকে রাতের আঁধারে ধরে এনে গুম করে ফেলতেন। হঠাৎ করেই তিনি আবিষ্কার করলেন সিনেটে সম্ভবত তাকে নিয়ে চক্রান্ত হচ্ছে। তিনি বিরোধীদলীয় সিনেটেরদের ধরে আনলেন এবং নিজে দাঁড়িয়ে থেকে প্রায় এক শ’ প্রভাবশালী, বয়োজ্যেষ্ঠ এবং রোমান সাম্রাজ্যের কীর্তিমান রাজনীতিবিদদের হত্যা করলেন। এরপর সাম্রাজ্য বিরোধীমুক্ত হয়েছে বলে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলতে লাগলেন।
৬০ সালের পর সম্রাটের বোধ হয় মস্তিষ্ক বিকৃতি ঘটল। তিনি রাত-বিরাত ঘর থেকে বের হন। প্রকাশ্য রাজপথে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে প্রস্রাব করা, গান করা কিংবা চিৎকার করে ভিক্ষা করার মতো নি¤œমানের কাজকর্ম করতে থাকেন। এ সময় তিনি নিজেকে খোদা বলে দাবি করেন। শুধু তা-ই নয়, তিনি বলতে থাকেনÑ ‘এই পৃথিবীতে খোদা বলে যদি কেউ থেকে থাকে তবে সেই খোদার দরকার আছে তার সাহায্য গ্রহণের; কিন্তু তার কোনো দরকার নেই কোনো খোদার সাহায্য।’ তিনি রাস্তাঘাটে চলতে ফিরতে গিয়ে হঠাৎ দাঁড়িয়ে যেতেন, তার পর কোনো পথচারীকে ধরে বলতেনÑ এই তুমি গান করছ কেন? আমাকে নিয়ে ব্যঙ্গ করে গান গাওয়া হচ্ছে? দাঁড়াও দেখাচ্ছি মজা! Ñ এ কথা বলেই তিনি তার সাথে থাকা প্রহরীদের নির্দেশ দিতেন ওই পথচারীর শিরñেদ করার জন্য। পথচারীর মস্তক দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যখন রাজপথের ধুলায় লুটিয়ে পড়ত, তখন সম্রাট নিরো অদ্ভূত এক পৈশাচিক অট্টহাসিতে ফেটে পড়তেন।
তিনি রাজপ্রাসাদে প্রায়ই শাহী ভোজে রোমের অভিজাতবর্গকে পিঠে-পায়েসসহ নানা রকম রাজভোগ খাওয়ানোর জন্য দাওয়াত করতেন। লোকজন এলে তিনি নিজে গান গাইতেন ও নাচতেন। রাজ্যের সম্মানিত বয়স্ক লোকদেরও গান গাইতে এবং নাচতে নির্দেশ দিতেন। তারা যখন সম্রাটের হুকুম পালন করতেন তখন তিনি বুড়োদের বেসুরো গান এবং ধ্যাতাং ধ্যাতাং নাচ দেখে খিলখিলিয়ে ও পিকপিকিয়ে হাসতেন। এর ক’দিন পর তিনি রাজপ্রাসাদ ত্যাগ করে টাইবার নদীর তীরবর্তী একটি রাজকীয় ফলের বাগানে গিয়ে উঠলেন। সেখানে তাঁবু টানিয়ে তিনি প্রিয় স্ত্রী সাবিনাকে নিয়ে থাকতেন। সাবিনার প্রতি নির্দেশ ছিল সম্পূর্ণ বিবস্ত্র হয়ে পালঙ্কের ওপর শুয়ে থাকা। সম্রাট উলঙ্গ স্ত্রীর শরীরের ওপর হালকা একটি চাদর দিয়ে আচ্ছাদনের ব্যবস্থা করতেন। চাদরটি ছিল অতিশয় পাতলা ও মসৃণ, যার ফাঁক দিয়ে সম্রাজ্ঞীর শরীর দেখা যেত। এরপর তিনি সেই তাঁবুর মধ্যে সাক্ষাৎপ্রার্থীদের ডাকতেন। কেউ যদি ভুলক্রমে সম্রাজ্ঞীর উলঙ্গ শরীরের দিকে তাকাতেন তাহলে আর রক্ষা ছিল নাÑ নির্ঘাত মরতে হতো।
এভাবেই সম্রাট নিরোর পাগলামি চলছিল। সম্রাটের পাগলামির শিকার হয়ে পুরো রোমবাসী পাগল হওয়ার উপক্রম হলেন। তার ক্ষমতা লাভের ১০ বছরের মাথায় তিনি ঘটিয়ে ফেললেন ইতিহাসের সবচেয়ে বড় দানবীয় ঘটনা। ’৬৪ সালের ১৮ জুলাই তিনি রোম নগরীতে আগুন ধরিয়ে দিলেন। নগরীর সবচেয়ে বড় বিপণিবিতান সার্কাস মাক্সিমাসে আগুনের সূত্রপাত হলো। ১৯ জুলাই রাত পর্যন্ত মোট ৪৮ ঘণ্টা ধরে রোম নগরী পুড়ে ছারখার হয়ে গেল। কেউ বলে তিনি বাঁশি বাজাচ্ছিলেন আবার কেউ বলে ভায়োলিন।
রোম নগরীর সেই আগুন নিয়ে বহু কথাÑ বহু উপকথা প্রচলিত। কেউ বলেন, রোমের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে লোকজন যখন রোমিউলাসের নাম উচ্চারণ করতেন তখন সম্রাট নিরোর শরীরে হিংসের আগুন জ্বলে উঠত। তিনি চাইতেন নতুন একটি শহর নির্মাণ করে ইতিহাসের মাইলফলক হিসেবে চিহ্নিত হতে। আবার অন্যরা বলেন, রোম নগরীর পুরনো বাড়িঘর ও অলিগলি তার একদম পছন্দ হতো না। তাই তো তিনি পুরনো নগরী জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ছারখার করে নতুন একটি শহর গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন নিজের নাম ও যশকে কৃতীময় করার জন্য।
আগুনে ভস্মীভূত হওয়ার দু-এক মাসের মধ্যেই নিরো নতুন নগরী নির্মাণের কাজে হাত দিলেন। প্রায় ১০ বর্গমাইল এলাকাজুড়ে তৈরি হতে থাকল নতুন ও অত্যাধুনিক শহর। সাম্রাজ্যের বিভিন্ন স্থান থেকে রাতারাতি সংগ্রহ করা হতো কোটি কোটি টন মার্বেল, গ্রানাইডসহ অন্যান্য মূল্যবান পাথর। জড়ো করা হলো লাখ লাখ ক্রীতদাসকে। চলতে থাকল নতুন শহর নির্মাণের কাজ। দিন-রাত ২৪ ঘণ্টা কাজ চলেÑ আর পাগলা সম্রাট একটি ঘোড়ায় চড়ে সেই দৃশ্য দেখেন এবং ভায়োলিন বাজিয়ে গান করেন। এ কাজ করতে করতে তার রাজকোষের সব অর্থভাণ্ডার শেষ হলে গেল। সেনাবাহিনীর বেতনভাতা আটকা পড়ার উপক্রম হলো; কিন্তু তখনো বাকি ছিল সম্রাটের দৃষ্টিতে নতুন দু’টি স্থাপনার নির্মাণ। একটি হলো নিজের জন্য বিলাসবহুল প্রাসাদ আর অন্যটি হলো ৩০ মিটার উচ্চতাবিশিষ্ট তার নিজের একটি ভাস্কর্য।
সম্রাটের অর্থমন্ত্রী অনেক বোঝালেন অর্থসঙ্কটের কথা; কিন্তু পাগলা সম্রাটের জিদÑ না, করতেই হবে ৩০০ একর জায়গার ওপর ‘ডোমাস আউরিয়া’ নামের প্রাসাদ এবং ৩০ মিটার উচ্চতাবিশিষ্ট ভাস্কর্য নির্মাণে ব্যয় ধরা হলো ৩০০ কোটি স্বর্ণমুদ্রা। টাকা কোথায়? পাগলা রাজা হুকুম দিলেন ট্যাক্স বাড়াও এবং রাজ্যের ধনীদের ধন লুট করো। হুকুম তামিল হলো এবং এক দিনের মধ্যে অর্থ সংগ্রহ হয়ে গেল; কিন্তু রাজ্যে দেখা দিলো ভয়াবহ অরাজকতা ও বিদ্রোহ। সম্রাট কঠোরহস্তে বিদ্রোহ দমনের চেষ্টা করলেন। ফলে রোম বিদ্রোহমুক্ত হলো বটে; কিন্তু প্রদেশগুলোতে অশান্তি ছড়িয়ে পড়ল। এভাবে চলল ৬৮ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত। ইতোমধ্যে সম্রাটের শহর, প্রাসাদ ও ভাস্কর্য নির্মাণের কাজ শেষ হলো। সম্রাট ৬৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে মহা ধুমধামে নতুন প্রাসাদে উঠলেন।
মার্চ মাসে গাল্লিয়া প্রদেশের গভর্নর গাইয়াস জুনিয়াস সম্রাটের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করলেন অতিরিক্ত কর আরোপের অভিযোগ তুলে। সম্রাট স্বয়ং যুদ্ধের ময়দানে উপস্থিত হলেন। পরিস্থিতি তার প্রতিকূলে চলে যাওয়ায় তিনি রোমে পালিয়ে এলেন। তিনি দুপুরের দিকে তার প্রাসাদে ফিরে ঘুমিয়ে পড়লেন। মাঝ রাতে জেগে দেখেন প্রাসাদের সব রক্ষী পালিয়ে চলে গেছে। এরপর তিনি প্রাসাদের বিভিন্ন কক্ষে অবস্থানরত তার বন্ধু-বান্ধবদের খোঁজ করলেন। দেখলেন কেউ নেইÑ সবাই তাকে ছেড়ে পালিয়েছে। এরপর তিনি চিৎকার করে বললেনÑ কেউ কি আছো যে আমাকে তার তলোয়ার দিয়ে হত্যা করতে পারে। প্রাসাদ বেদিতে তার আর্তচিৎকার প্রতিধ্বনিত হলো; কিন্তু কেউ এলো না।
সম্রাট পাগলের মতো প্রাসাদ থেকে দৌড়ে বের হয়ে এলেন গভীর রাতে। তারই প্রতিষ্ঠিত শহরের অলিগলিতে চিৎকার করলেন। কেউ তার জন্য দরজা খুলল না। ইতোমধ্যে তার চারজন বিশ্বস্ত চাকর ও বালক স্ত্রী স্পারস এগিয়ে এলেন। সম্রাট তাদের কবর খোঁড়ার জন্য নির্দেশ দিলেন। এমন সময় সম্রাটের কাছে খবর এলোÑ রোমান সিনেট তাকে গণশত্রু আখ্যা দিয়ে গ্রেফতারের নির্দেশ দিয়েছে। এ খবর শুনে নিজেকে আর স্থির রাখতে পারলেন না। নিজের চাকু দিয়ে নিজের গলার রগ কেটে আত্মহত্যা করলেন। মৃত্যুর সময় উচ্চারণ করলেন সেই বিখ্যাত বাণীÑ ‘কুয়ালিস আর্টিফেক্স পিরিও’। ইংরেজিতে যার অর্থ দাঁড়ায়Ñ "What an artist dies in me." তারিখটি আবার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছিÑ ৬৮ সালের ৯ জুন, সময় ভোররাত। স্থান : রাজপথ।