১২মে ছিল মা দিবস। এ দিনে বিশ্বের সব সন্তানই তার
মাকে মনে করে। কিন্তু একটিমাত্র দিনে কি মায়ের ঋণ শোধ হয়। প্রতিটি দিনই
তো হওয়া উচিত মায়ের জন্য। এ মা দিবসে বিশ্বের সব মাকে শুভেচ্ছা।
একটি মানুষের প্রথম আশ্রয়ই তার মা। মাকে ঘিরেই কাটে তার শৈশব। সন্তানের
বেড়ে ওঠায় মা-ই প্রধান অবলম্বন। মা-ও তার নিজের সব সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য
বিসর্জন দিয়ে সন্তানকে বড় করে তোলেন। তারপর একদিন সন্তান বড় হয়,
প্রতিষ্ঠিত হয়। তত দিনে মায়ের প্রয়োজন হয় সন্তানের সাহায্যের। প্রয়োজন
হয় সেবার, আশ্রয়ের। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই সন্তানেরা মাকে সে
সাহায্য-সেবা দিতে পারে না। মা থেকে যায় অবহেলায়।
ঘটনা ১ : সুফিয়া বেগম (৮০)। ১২ সন্তানের গর্বিত মা তিনি। স্বামী শাহেদ
আলী ছিলেন সরকারি চাকুরে। ভীষণ কষ্ট করে মা তার সন্তানদের মানুষ করেছেন।
লেখাপড়া শিখে সবাই নিজ নিজ অবস্থানে স্টাবলিস্টড। বুড়ো মা গ্রামে একা
থাকেন। কালেভদ্রে কারো সময় হলে তবেই তারা বাড়ি যায় মাকে দেখতে। কিন্তু
বুড়ো মা কাজের লোকের তত্ত্বাবধানে কোনোরকমে দিনাতিপাত করেন। কথাপ্রসঙ্গে
বৃদ্ধা সুফিয়া বেগম বলেন, বড় ছেলে মনু মিঞা জন্মের পর থেকে ভীষণ অসুস্থ
থাকে দিনের পর দিন। তার অসুস্থতা চরমে যায়, বাঁচার আশাই ছিল ক্ষীণ; তাই
বৃদ্ধ সুফিয়া বেগম কবিরাজের কথায় রাতভর বাঁশঝাড়ের তলায় একপায়ে
দাঁড়িয়ে ছিলেন ছেলেকে বাঁচানোর শর্তে। রাতভর না খেয়ে মশার কামড়,
ভূতপ্রেতের ভয়ও মাকে টলাতে পারেনি। কী আশ্চর্যের বিষয়! পরদিন থেকে ধীরে
ধীরে মনু মিঞা সুস্থ হতে লাগল। এই হচ্ছে স্বার্থত্যাগী দুখিনী মা।
ঘটনা ২ : স্বামীপরিত্যক্তা পরী বেগম একমাত্র সন্তান ফরিদকে নিয়ে বাপের
বাড়িতে আশ্রিতার মতো বসবাস করেন। বহু কষ্ট আর ভাই-ভাবীদের অনুগ্রহে
ছেলেকে মানুষ করেন। আশা ছিল ছেলে বড় হলে সব আশা পূরণ হবে। কিন্তু বড় হয়ে
ফরিদকে চাকরির অছিলায় মাকে ছেড়ে অনেক দূর শহরে বাস করতে হয়। মাকে সাথে
রাখবে সে ধরনের পরিস্থিতি তার নেই। বউ এতে রাগ করে বলে উটকো ঝামেলা। ছেলে
বেচারা বউয়ের সাথে পেরে ওঠে না। দুখিনী মা ভাই-ভাবীদের অত্যাচার-অনাচারে
একসময়ে অতিষ্ঠ হয়ে ছেলের বাড়িতে চলে আসেন। শুরু হয় শাশুড়ি-বউতে ঝগড়া।
এমনই ব্যাপারগুলো যেন প্রতিদিনকার সাধারণ ঘটনা। ছেলে ফরিদ এতে মাকেই কথা
শোনায়। মা নিজের ছেলের এরূপ অবহেলা সহ্য করতে না পেরে একদিন রাতের বেলা
সবাই ঘুমিয়ে পড়লে ঘর থেকে বেড়িয়ে যান। পরদিন সকালে বড় রাস্তার মোড়ে
পরী বেগমের রক্তাক্ত লাশটি বেওয়ারিশ হিসেবে আঞ্জুমান মুফিদুলে তুলে নিয়ে
যায়।
ঘটনা ৩ : সাত সন্তানের গর্বিত জননী হাজেরা বেগম। ব্যবসায়ী স্বামীর ঘরে
সন্তানদের খুব সাধারণভাবেই মানুষ করেছেন। যার যার মতো সবাই বসবাস করলেও
মায়ের খোঁজখবর নেয়া, দেখাশুনা করা সব সন্তানের ছিল নিত্যদিনের রুটিন। তাই
মৃত্যুর আগ পর্যন্ত হাজেরা বেগম কোনো দুঃখবোধ মনে পোষণ করেননি। পাকস্থলির
ক্যান্সারে হাজেরা বেগমের মৃত্যু হলেও সন্তানদের আদরযতœ মমতায় তার জীবন
ছিল ভরপুর। বড় ছেলে আহসান উল্লাহ মজুমদার বুয়েটের প্রফেসর। বৃদ্ধ মায়ের
চিকিৎসার জন্য জীবনের সর্বস্ব ত্যাগ করেছেন। টাকা-পয়সা, বারবার বিদেশে
নিয়ে চিকিৎসা করা, মাকে রোগযন্ত্রণা থেকে মুক্ত রাখার জন্য সব রকম উন্নত
চিকিৎসাসেবা দেয়ার চেষ্টা করেছেন। মেজ মেয়ে শাহীন সারাক্ষণ কাছাকাছি
থাকতেন। বাকিরাও দূরদূরান্ত থেকে এসে মাকে দেখে যেতেন; যার যার সাধ্য
অনুযায়ী সেবাযতœ করতেন। মা হাসপাতালে থাকলে তার ছয় সন্তানই তাকে পালা করে
পাহাড়া দিতেন, সেবাযতœ করতেন। প্রতিমাসেই রক্ত দিতে হতো মাকে। সন্তানেরা
তা নিজেরাই ভাগ করে দিতেন। এতে মা সুস্থ থাকতেন। তার পরও হাজেরা খাতুনকে
মৃত্যুর কঠিন কারাগার থেকে মুক্ত করতে পারেননি তার সন্তানেরা।
ঘটনা ৪ : বৃদ্ধা সাহেরা খাতুনের বয়স ৭০ বছর। সাত সন্তানের গর্বিত
জননী। তিন ছেলে ও চার মেয়ের সবাই যার যার অবস্থানে প্রতিষ্ঠিত। দেশ-বিদেশে
সন্তানদের অবস্থান হলেও মাকে তারা খুবই আদরযতেœ রেখেছেন। সাহেরা খাতুনের
এত বয়স হওয়া সত্ত্বেও তাকে ততটা বয়স্ক মনে হয় না। এর মূল কারণ
ছেলেমেয়েদের যতœাত্মি। সন্তানেরা ছোট থাকতে মা যেমন করে তাদের লালন পালন
করেছিলেন, সন্তানেরাও মাকে সেই রকমই করছেন। কখনো সাহেরা খাতুন নিউইর্য়ক,
কখনো হিউস্টন, কখনও কানাডা, কখনো জাপান, কখনো বা বাংলাদেশে বসবাস করেন।
স্বামী মৃত; তাই সন্তানদের বাসায় যখন যার কাছে থাকতে ইচ্ছে করে তিনি
সেখানেই চলে যান। ঘণ্টার পর ঘণ্টা দেশ-বিদেশে আত্মীয়-পরিজনের সাথে ফোনে
আলাপ করেন। কোনো ছেলে বা বউ অথবা মেয়েজামাই তাকে বাধা দেয় না। বরং মা
কাছে থাকলে তারা খুশি হয়। তিনি এখনো বেঁচে আছেন এবং সম্পূর্ণ সুস্থ।
বর্তমানে তিনি নিউইয়র্ক মেঝ মেয়ের বাসায় বেড়াচ্ছেন।
আঞ্জুমান আরা বেগম
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন