রবিবার, ২৭ অক্টোবর, ২০১৩

পহেলা নভেম্বর মাঠে নামছে হেফাজত : কওমি মাদরাসা সরকারি নিয়ন্ত্রণে আইন পাস হলে গৃহযুদ্ধ শুরু হবে : আল্লামা শফী

 
হেফাজতের আমির ও কওমি মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড (বেফাক) চেয়ারম্যান আল্লামা শাহ আহমেদ শফী দেশের কওমি মাদরাসাগুলোতে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার তত্পরতা থেকে সরে আসতে সরকারের প্রতি হুশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন। তিনি গতকাল চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, আলেমদের কথা না শুনে একগুঁয়েমি করে সরকার কওমি মাদরাসা কর্তৃপক্ষ আইন-২০১৩ পাস করলে দেশে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে যাবে। আল্লামা শফী আরও বলেন, কওমি মাদরাসাগুলো যদি সরকারি নিয়ন্ত্রণে যায়, তবে দেশে ধর্মীয় শিক্ষা থাকবে না। এ জন্য সরকারকে বারবার বলছি, এ মাদরাসাগুলো পূর্বপুরুষদের রেখে যাওয়া নিয়ম অনুযায়ী যেভাবে চালিয়ে আসছি সেভাবে রাখার জন্য।
এদিকে কওমি মাদরাসা কর্তৃপক্ষ আইন-২০১৩ পাস থেকে সরকারের বিরত থাকা ও ১৩ দফা দাবি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। গতকালের সংবাদসম্মেলনে হেফাজতের মহাসচিব আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরীর পক্ষে এসব কর্মসূচি ঘোষণা করেন সংগঠনটির সাংগঠনিক সম্পাদক আজিজুল হক ইসলামবাদী।
কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে ১ নভেম্বর সারা দেশে বিক্ষোভ সমাবেশ, ২ নভেম্বর চট্টগ্রাম হাটহাজারী কলেজ ময়দানে মহাসমাবেশ এবং ১৫ নভেম্বরের মধ্যে সব বিভাগীয় শহরে ধারাবাহিকভাবে মহাসমাবেশ। এদিকে হেফাজত নেতারা সরকারকে হুশিয়ার করে দিয়ে বলেছেন, এসব কর্মসূচিতে বাধা দেয়া হলে হরতালসহ কঠিন কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে।
হাটহাজারী ডাকবাংলোয় একটি কমিউনিটি সেন্টারে সংবাদসম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনে আজিজুল হক ইসলামবাদী সরকার এই আইনের মাধ্যমে নিজেদের মনোনীত কিছু লোককে চাপিয়ে দিয়ে বস্তুত কওমি মাদরাসাগুলো ওপর খবরদারি করতে চায়। সনদের তথাকথিত স্বীকৃতির নাম দিয়ে আলিমদের মধ্যে দ্বিধাবিভক্তি সৃষ্টিরও গভীর চক্রান্ত করা হচ্ছে। আমরা মনে করি, আলিম-ওলামাকে ইমান-আকিদার প্রশ্নে যে কোনো আন্দোলন থেকে বিরত রেখে আত্মরক্ষামূলক ভূমিকায় ঠেলে দেয়ার জন্য এটি সরকারের আরেকটি নতুন চাল। দেশের শীর্ষস্থানীয় আলিম, কওমি মাদরাসা বোর্ডের দায়িত্বশীল ও বিভিন্ন মাদরাসার প্রিন্সিপালরা সরকারের এই হঠাকারী সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ রয়েছেন।
তিনি আরও বলেন, সরকার ও অতি উত্সাহী কিছু মিডিয়া কওমি মাদরাসার বিরুদ্ধে তথ্য-প্রমাণ ছাড়া একের পর এক মিথ্যা, বানোয়াট ও কল্পনাপ্রসূত সংবাদ পরিবেশন করে জনমনে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে। লালখান বাজার মাদরাসায় ঘটে যাওয়া অগ্নিকাণ্ডের দুর্ঘটনাকে ঘিরে হাটহাজারী মাদরাসাসহ সারা দেশের কওমি মাদরাসাগুলোকে জঙ্গি ও বোমাবাজির সঙ্গে জড়িত প্রমাণ করার জন্য ভয়াবহ অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। আমরা দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলতে চাই, বাংলাদেশের কোনো কওমি মাদরাসায় কোনো ধরনের সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদী কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার প্রমাণ নেই। এসব মাদরাসায় সত্, আদর্শবান ও খোদাভীরু আলিম তৈরি হয়, যারা সারা জীবন সমাজ, সমাজের মানুষ ও মানবতার সেবায় নিজেদের জীবন উত্সর্গ করে যায়। দেশের আইনবিরোধী অনৈতিক কাজে তারা কখনও সম্পৃক্ত হয়নি।
দেশের কওমি মাদরাসাগুলোকে সরকারি নিয়ন্ত্রণে আনার লক্ষ্যে বহু দিন থেকে নানা ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত চলে আসছে। এরই ধারাবাহিকতায় জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০-এ বিধৃত মাদরাসা শিক্ষা নিয়ন্ত্রণের কৌশল হিসেবে সরকার ১৫ এপ্রিল ২০১২ সালে বাংলাদেশ কওমি মাদরাসা শিক্ষা কমিশন নামে ১৭ সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করে। এই কমিটির চেয়ারম্যান করা হয়, হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের আমির, কওমি মাদরাসা শিক্ষাবোর্ড (বেফাক) চেয়ারম্যান, উপমহাদেশের বিখ্যাত কওমি মাদরাসা দারুল উলুম হাটহাজারীর মুহতামিম, আল্লামা শাহ আহমদ শফীকে। সরকারের ছলচাতুরী বুঝতে পেরে আল্লামা শাহ আহমদ শফীসহ দেশের শীর্ষ ওলামায়ে কেরাম এই কমিশন প্রত্যাখ্যান করেন। কিন্তু সরকার তার আজ্ঞাবহ মাওলানা ফরিদুদ্দিন মাসউদ ও মাওলানা রুহুল আমিনের মাধ্যমে কওমি মাদরাসা ও ওলামায়ে কেরামদের সরকারের পক্ষে আনতে ব্যর্থ হয়ে কওমি মাদরাসা শিক্ষা কর্তৃপক্ষ আইন ২০১৩-এর খসড়া তৈরি করে। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম ও সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে যে, গত ৮ অক্টোবর একটি আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা আহ্বান করে খসড়া আইনটি চূড়ান্ত করা হয়। এরপর অতি দ্রুত, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ের মতামত নেয়া হয়। গত ২০ অক্টোবর সকালে তা প্রশাসনিক উন্নয়নসংক্রান্ত সচিব কমিটির বৈঠকে চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য সুপারিশ করা হয়। এখন শুধু মন্ত্রিসভায় অনুমোদন হলেই তা অধ্যাদেশ আকারে জারি করা হবে।
আমরা মনে করি, সরকারের ঘাড়ে চেপে-বসা ইসলামবিদ্বেষী একটি চক্রের প্ররোচনায় নানা ছলছুতোয় কওমি মাদরাসাগুলো কব্জা করার অশুভ পথে পা বাড়াতে উদ্যত হয়েছে সরকার। কেননা একদিকে তারা কওমি মাদরাসার দরদি সেজে তাদের মতো করে কওমি সনদের স্বীকৃতির প্রলোভন দেখাচ্ছে, অন্যদিকে দেশের সব কওমি মাদরাসা, আলিমসমাজ ও ধর্মপ্রাণ মানুষের অবিসংবাদিত আধ্যাত্মিক নেতা, শায়খুল ইসলাম আল্লামা শাহ আহমদ শফীর বিরুদ্ধে কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য করে যাচ্ছে দিনের পর দিন। আমরা সরকারকে আবারও সতর্ক করতে চাই—কওমি মাদরাসা কর্তৃপক্ষ আইনের নামে হাজার হাজার কওমি মাদরাসার ওপর ছড়ি ঘোরানোর পরিকল্পনা থেকে সরে আসুন। নইলে সারা দেশের আলিম সমাজ ও মাদরাসা-শিক্ষকরা সর্বস্তরের মুসলমানদের সঙ্গে নিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে সরকারের এই অশুভ পদক্ষেপ রুখে দাঁড়াবে। গড়ে তুলবে দুর্বার গণআন্দোলন। কওমি মাদরাসার অস্তিত্ব ও স্বকীয়তা রক্ষার প্রয়োজনে কঠিনতর কর্মসূচিও ঘোষণা করা হবে।
বিগত ২৫ সেপ্টেম্বর আমরা সারা দেশে স্মারকলিপি দিয়ে সরকারকে কওমি মাদরাসার স্বার্থবিরোধী এই আইন বাস্তবায়ন থেকে বিরত থাকার দাবি জানিয়েছি। কিন্তু শান্তিপূর্ণভাবে উপস্থাপিত আমাদের দাবির প্রতি ভ্রুক্ষেপ না করে সরকার তার নিজস্ব এজেন্ডা বাস্তবায়নের পথেই অগ্রসর হচ্ছে। আমরা মনে করি এ পথ থেকে সরে না এলে সরকারকে চড়া মূল্য দিতে হবে।
আজিজুল হক ইসলামবাদী বলেন, আমরা স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিতে চাই, দেশে হাজার হাজার কওমি মাদরাসার লাখ লাখ শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও তাওহিদি জনতা এই আইন কখনো বাস্তবায়ন হতে দেবে না ইনশাআল্লাহ।
বিগত ৫ মে শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের শান্তিপূর্ণ সমাবেশে বিদ্যুিবচ্ছিন্ন করে, রাতের অন্ধাকারে নবীপ্রেমিক জনতার ওপর যৌথবাহিনী দিয়ে এক লাখ পঞ্চান্ন হাজার রাউন্ড গুলি চালানো হয়েছে। লাখ লাখ নিরীহ মুসলমানদের ওপর ইতিহাসের বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ড চালানো হয়েছে। এ ঘটনা অসংখ্য ওলামা-পীর-মাশায়েখকে শহীদ করা হয়েছে। বহু মানুষ চিরদিনের জন্য পঙ্গু ও অন্ধ হয়ে গেছেন। আমাদের শান্তিপূর্ণ মিছিলে সরকারদলীয় ক্যাডার, নাস্তিক-মুরতাদদের দোসররা নৃশংস হামলা চালালো অথচ উল্টো আমাদের বিরুদ্ধে সারা দেশে অর্ধশতাধিক মামলা হয়রানি করা হচ্ছে।
বায়তুল মোকাররম এলাকায় সরকারি দলের সন্ত্রাসীরা সেদিন পবিত্র কোরআন পুড়িয়ে হেফাজতের নেতাকর্মীদের ওপর দায় চাপানোর অপচেষ্টা করা হয়, যা অত্যন্ত ন্যক্কারজনক। এই সরকারের মন্ত্রী-এমপিসহ গুরুত্বপূর্ণ কতিপয় দায়িত্বশীল হেফাজতের বিরুদ্ধে প্রতিদিন অব্যাহত মিথ্যাচার করে চলেছেন। আমীরে হেফাজত, শায়খুল ইসলাম, আলামা শাহ্ আহমদ শফীর বিরুদ্ধে জাতীয় সংসদসহ সর্বত্র কুত্সা রটিয়ে আলিমসমাজকে জাতির সামনে হেয়প্রতিপন্ন করার অপচেষ্টা করা হচ্ছে। দেশের প্রখ্যাত আলিম, সাবেক মন্ত্রী মুফতি মুহাম্মদ ওয়াক্কাস ও মুফতি হারুন ইজহারসহ অসংখ্য আলিম-ওলামা, মাদরাসা ছাত্র ও ধর্মপ্রাণ তাওহিদি জনতাকে গ্রেফতার করে রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন করা হচ্ছে। আমরা এর তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছি। অবিলম্বে গ্রেফতারদের নিঃশর্তমুক্তি এবং দায়ের করা সব মিথ্যা মামলা প্রত্যাহারের দাবি জানাচ্ছি।
সংবাদসম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ আমির আল্লামা শাহ আহমদ শফী, নায়েবে আমির মাওলানা শামশুল আলম, কেন্দ্রীয় মহাসচিব আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী, নায়েবে আমির হাফেজ তাজুল ইসলাম, মাওলানা লোকমান, যুগ্ম সম্পাদক মাওলানা মঈনুদ্দী রুহী, মাওলানা সেলিম উল্লাহ, হাটহাজারী উপজেলা হেফাজতের আমির মাওলানা মাহমুদুল হাসান, হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম সাংগঠনিক সম্পাদক মাওলানা হাবিবুল্লাহ আজাদী, নির্বাহী সদস্য মাওলানা মুফতি হাবিবুল রহমান কাসেমী, উত্তর জেলা সাংগঠনিক সম্পাদক মাওলানা মীর ইদ্রিস, চট্টগ্রাম মহানগর যুগ্ম সম্পাদক মাওলানা মোজাম্মেল হক, নির্বাহী সদস্যে মাওলানা আবদুল্লাহ, হেফাজতে ইসলাম হাটহাজারী উপজেলা সাধারণ সম্পাদক মাওলানা জাকিরিয়া নোমান, সহ-সাধারণ সম্পাদক মাওলানা সফিউল্লাহ, আহসান উল্লাহ, সাংগঠনিক সম্পাদক জাহাঙ্গির মেহেদী, মহানগর নেতা মাওলানা ফয়সল তাজ, মাওলানা ইব্রাহিম সিকদার, মাওলানা আনাস আহমেদ উল্লাহ প্রমুখ। Daily Amerdesh

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন