এক.
এ লেখা যখন লিখছি তখন গাজায় নয়দিনে ইসরাইলের বোমা হামলায় কমপক্ষে ২২৬ জন মারা গিয়েছে, আহত হয়েছে ১৬৮৫। এদের অধিকাংশই সাধারণ মানুষ। নিহতদের মধ্যে রয়েছে শিশু ও নারী। সারে সারে কফিন দিয়ে মোড়ানো শিশুদের লাশ সারা দুনিয়ায় মানুষের বিবেককে আহত ও সংবেদনা জাগ্রত করেছে। ইসরাইলের বিরুদ্ধে তীব্র ক্ষোভ সৃষ্টি করেছে। মানুষ নিন্দা জানাচ্ছে নানান ভাবে। বাংলাদেশ ব্যতিক্রম নয়।
কিন্তু ‘গাজায় হত্যা বন্ধ কর’, ‘শিশু হত্যা বন্ধ কর’, ‘Stop Killing in Gaza’, ‘Stop Killing Children’, এইসব প্লাকার্ড হাতে বাংলাদেশে এবং বিভিন্ন দেশে ভদ্রলোকী শ্লোগান দিয়ে শহরের নিরাপদ রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে হাজার চেঁচামেচি করলেও ইসরাইল বিন্দুমাত্র তোয়াক্কা করবে না, করছে না, এবং তাদের বোমা মারাও থামবে না। অতীতেও ইসরাইল তোয়াক্কা করে নি, এখনও করবে না। আজকের খবর হচ্ছে সাময়িক যুদ্ধ বিরতিতে দুই পই সম্মত হয়েছে। কিন্তু সেটা সাময়িক। যুদ্ধ শুরুর আগে ফিলিস্তিনে যে অবস্থা থাকে তাকে এক হিসাবে লম্বা যুদ্ধবিরতি বলা চলে। এই বাস্তবতা মনে রেখেই ফিলিস্তিনের আলোচনা করতে হবে।
ফিলিস্তিন ও সমগ্র মধ্যপ্রাচ্যে যা ঘটছে তাকে সরলীকরণ করে বোঝার চেষ্টা বোকামি। কিন্তু সাধ্য মতো চেষ্টা করা আমাদের জন্য খুবই জরুরী। ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠছে যে মধ্যপ্রাচ্যের ঘটনাবলীর কোন প্রকট প্রতিক্রিয়া বাংলাদেশে না ঘটলেও তার প্রভাব গভীর। বাংলাদেশ বিশ্বসভা থেকে বিচ্ছিন্ন কোনো দ্বীপ নয়। বাংলাদেশের আগামি দিনের রাজনীতি নানা ভাবে মধ্যপ্রাচ্যের ঘটনাবলীর দ্বারা প্রভাবিত হবে। আগামি আলোচনার সূত্র হিসাবে আজ শুধু কিছু বিষয় উত্থাপন করে রাখব। গাজায় ইসরাইলী হামলার যারা প্রতিবাদ জানাচ্ছেন, তাদের প্রতি সংহতি জানানোই মূল উদ্দেশ্য। সেটা করতে গিয়ে ফিলিস্তিনীদের প্রতি আমাদের একাত্মতার জায়গাটুকু খানিক সাফ করে রাখবার চেষ্টা করব।
এটা পরিষ্কার যারা প্লাকার্ড হাতে প্রতিবাদ করছেন তারা তাঁদের ব্যক্তিগত বিবেকের তাড়া থেকে করছেন। ব্যক্তির দায়বোধ গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশ থেকে এর বেশী কিছু করার আছে কিনা সেটা এই দায়বোধে রাস্তায় প্লাকার্ড ও ব্যানার হাতে দাঁড়ানোর মধ্য দিয়ে ভাববার একটা পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, সেটাও কম নয়। নিদেন পক্ষে ফিলিস্তিন নিয়ে আমাদের আরো গভীর ভাবে ভাববার উৎসাহ বাড়বে।
তবে জেনে হোক বা না জেনে হোক, যখন আমরা শুধু শান্তি, অস্ত্র বিরতি, ও সদর্থে হত্যার নিন্দা করি, তখন আমরা ফিলিস্তিনী জনগণের মুক্তি সংগ্রামের বিরুদ্ধে দাঁড়াই এবং তাদের ন্যায়সঙ্গত সশস্ত্র যুদ্ধকে ‘ক্রিমিনালাইজ’ করার শর্ত তৈরি করি। শান্তি, অহিংসা ও যুদ্ধ বিরতির কথা বলে বাংলাদেশের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধেও অনেক ভদ্রলোকী বয়ান ছিল। তাদের কথা শুনলে আমরা আজও পাকিস্তানের উপনিবেশ থাকতাম। ইসরাইলের বোমা হামলা ও হত্যাযজ্ঞের নিন্দা করলেও, হামাসসহ ফিলিস্তিনীদের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে আমরা নীরব। অথচ দরকার মুক্তিযুদ্ধের প্রতি একাত্মতা জানানো। সেই যুদ্ধে যারা নেতৃত্ব দিচ্ছেন, তাদের সম্পর্কে আমাদের অনেক ভুল ধারণা আছে। পাশ্চাত্য প্রচার প্রপাগান্ডার শিকার হয়ে আছি অনেকেই। এই পরিস্থিতি থেকে মুক্ত হওয়া দরকার। আপাতত মনে রাখা দরকার হামাস গাজায় গণতান্ত্রিক ভাবে নির্বাচিত রাজনৈতিক কর্তৃত্ব। দুই হাজার সাত সাল থেকেই হামাস গাজার নির্বাচিত প্রতিনিধি। ফিলিস্তিন পার্লামেন্টে ২০০৬ সালে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোট পেয়ে হামাস আল ফাতাহকে পরাজিত করে। সেই থেকে তারাই কর্তৃত্বের আসনে আছেন।
এ কারণে ইসরাইল ও তাদের স্বার্থ সংরক্ষক রাষ্ট্রগুলোর মানদণ্ড দিয়ে হামাসকে বিচার করা যাবে না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, মিশর, জর্দান ও ইউরোপের অল্প কয়েকটি রাষ্ট্র ছাড়া হামাসকে নেতিবাচক ভাবে অন্য কেউ দেখে না। তাদের মধ্যে চিন, রাশিয়া, তুরস্ক ছাড়াও অনেক আরব দেশ রয়েছে। ফিলিস্তিনী জনগণ কিভাবে কাদের নেতৃত্বে তাদের ন্যায়সঙ্গত লড়াই চালিয়ে যাবে সেটা তাদের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। তারপরও হামাসের সমালোচনা হতে পারে। অবশ্যই। কিন্তু যারা ইসরাইলের নিন্দা করছেন তারাই আবার ইসরাইলী প্রপাগান্ডার কারণে হামাসকে ‘সন্ত্রাসী’ সংগঠন বলছেন। তারা আসলে গাজার ফিলিস্তিনীদেরই মূলত সন্ত্রাসী বলছেন, কারণ এই ফিলিস্তিনীরাই হামাসকে তাদের রাজনৈতিক কর্তৃত্ব হিসাবে মেনে নিয়েছে। ফিলিস্তিনীরা জাতিগত ভাবেই ‘সন্ত্রাসী’ সেটা ইসরাইলের প্রচার। হামাসকে সন্ত্রাসী বলা মানে ইসরাইলী প্রচারে সায় দেওয়া। সেই প্রচারে সায় দিয়ে গাজায় বোমা হামলা ও শিশু হত্যার নিন্দা তামাশা হয়ে যায়। যারা মরছে তারা তো ইসরাইলের যুক্তি অনুসারে ‘সন্ত্রাসী’ আর ইসরাইল তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতেই মূলত বোমা হামলা চালাচ্ছে। স্ববিরোধী অবস্থান নিয়ে গাজার হামলার বিরুদ্ধে দাঁড়ানো ঠিক কিনা সেটা সবাইকে ভেবে দেখতে বলব।
আসলে এ লড়াইকে জায়নবাদ, জাতীয়তাবাদ ও সাম্রাজ্যবাদী যুগের ‘সেটলার কলোনিয়ালিজম’ হিশাবে বুঝতে না পারলে আমরা মারাত্মক ভুল করব। বাংলাদেশের রাজনীতির সঙ্গে এর প্রাসঙ্গিকতাও আমরা ধরতে পারব না।
আমরা উপনিবেশ সম্পর্কে জানি। কারণ আমরা ইংরেজের অধীনে ছিলাম। ইংরেজ আমাদের রাজনৈতিক ভাবে পরাধীন করেছিল সম্পদের লোভে। সেটা স্রেফ লুণ্ঠন যেমন তেমনি আইন করে জমি থেকে খাজনা পাওয়া থেকে শুরু করে, এই উপমহাদেশকে তাদের পণ্যের বাজারে পরিণত করা ইত্যাদি ছিল সেই উপনিবেশের কিছু দিক। আমাদের শ্রম শক্তিও তারা শোষণ করেছে। সাম্রাজ্যবাদের এই রূপটা আমাদের চেনা। কিন্তু উত্তর ও দক্ষিন আমেরিকা এবং অস্ট্রেলিয়ায় ইউরোপের সাদা মানুষেরা গিয়ে যখন পুরা মহাদেশ তাদের দখলে নিয়ে নিল, তখন তারা ইংরেজের মতো শুধু ঔপনিবেশিক সম্পর্কের ভিত্তিতে শোষণ করে নি। সেই মহাদেশের আদি অধিবাসীদের অধিকাংশকেই তারা নিষ্ঠুর ভাবে হত্যা করে। বহু জাতিকে সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন করে দেয়। এখনও যারা বেঁচে আছে তাদেরকে তারা তাদের নির্দিষ্ট জায়গাতে বন্দিশালার মতো ‘রিজার্ভ’ বানিয়ে অদৃশ্য করে রেখেছে। সেইসব দেশে ইউরোপীয়রা শুধু ঔপনিবেশিক শাসন কায়েম করে নি, দেশ দখল করে নিয়ে নিজেরাই সেখানে বস্তি গেড়ে বসেছে। পুরা মহাদেশ তাদের দখলে নিয়ে নিয়েছে তারা। যেসব জাতি ধ্বংস ও বিলুপ্ত হয়েছে তাদের কথা আমরা খুব একটা শুনি না। যারা এখনও ধুঁকে ধুঁকে বেঁচে আছে সেই জাতিগুলো বিলুপ্তির পথে।
এই যে স্থানীয় অধিবাসীদের উৎখাত ও হত্যা করা এবং করতে না পারলে রিজার্ভে রেখে দেওয়া আর পুরা দেশ, মহাদেশ বা ভূখণ্ড দখল করে নেওয়া একেই বলা হয় ‘সেটলার কলোনিয়ালিজম’। এ নিয়ে বিস্তর গবেষণা আছে। পাঠকদের জন্য আপাতত এই তথ্যটুকুই যথেষ্ট। উপনিবেশ স্থাপন করে বিলাতে বসে শোষণ লুণ্ঠন আর স্থানীয় অধিবাসীদের উৎখাত করে নিজেরা বসতি স্থাপন করার উপনিবেশ এই দুইয়ের মধ্যে পার্থক্য বিশাল। আমাদের অভিজ্ঞতায় সেটা নাই বলে ‘সেটলার কলোনিয়ালিজম’-এর ভয়াবহতা আমরা বুঝতে পারি না। যে কারণে ফিলিস্তিনীদের লড়াইয়ের মর্ম বুঝতেও আমরা অধিকাংশই অক্ষম। ইহুদিদের অধিকারের কথা বলতে গিয়ে অতি দরদী হয়ে যারা ইসরাইলের পাবলম্বন করার অর্থ সেটলার কলোনিয়ালিজমের পক্ষে বলা। এই ধরনের উপনিবেশীকরণের যারা শিকার তারা যখন সেই ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে জানপরান লড়ে তার গুরুত্ব ও তাৎপর্য আমরা বুঝি না। বুঝি না বলেই তাদের ন্যায়যুদ্ধকে অতি অনায়াসে ‘সন্ত্রাস’ বলতে আমাদের বাঁধে না।
ইউরোপ থেকে ইহুদি ধর্মাবলম্বীরা যখন পাশ্চাত্যের সাম্রাজ্যবাদী শক্তির সহায়তায় ফিলিস্তিনীদের ভূমি দখল করে নিল আর সেটাকেই তাদের ভূখণ্ড দাবি করে ফিলিস্তিনীদের তাড়িয়ে দিল সেটা অবশ্য নতুন ধরনের সেটলার কলোনিয়ালিজম। কারণ সেটা সম্ভব হয়েছে সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর প্রত্য সহায়তায়। অতীতের সেটলার কলোনিয়ালিজমের সঙ্গে এখানে তার পার্থক্য আছে। ফিলিস্তিনীদের তাহলে শুধু ইহুদিবাদী ইসরাইল রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে লড়লে হচ্ছে না, সেটলার কলোনিয়ালিজমের বিরুদ্ধে তাদের লড়াই একই সঙ্গে সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াই হয়ে উঠেছে। এ এক অসম ও অসম্ভব যুদ্ধ। আর সে কারণেই অতীতের যে কোন গণযুদ্ধের চেয়ে ফিলিস্তিনীদের লড়াই মানবেতিহাসের সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ও দুনিয়ার সকল মানুষের ঐতিহাসিক অভিমুখ নতুন করে নির্ণয়ের লড়াই।
এরপর রয়েছে জায়নিজম (zionism) বা জায়নবাদ। প্রথমত বুঝতে হবে জায়নবাদ হচ্ছে ইহুদি জাতীয়তাবাদ। জাতীয়তাবাদ থেকে সে আলাদা কিছু না। জায়নবাদীরাও তাদের সংগ্রামকে জাতীয় মুক্তি সংগ্রামই বলে। ইউরোপে অত্যাচারিত ও নিপীড়িত ইহুদিদের পক্ষে দাঁড়ানো ও তাদের অধিকারের জন্য লড়াই সে কারণে ন্যায্য। কিন্তু নিপীড়িত জনগোষ্ঠির পক্ষে দাঁড়ানো আর জায়নবাদের পক্ষে দাঁড়ানো এক কথা নয়।
জাতীয়তাবাদ তার আত্মপরিচয়কে ভূমিসংশ্লিষ্ট দেখে। মাতৃভূমি জাতীয়তাবাদের খুবই গুরুত্বপূর্ণ ধারণা। বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ইহুদিরাও সেই অনুপ্রেরণায় নিজেদের জন্য একটি বাসভূমি (homeland) বা দেশের স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। কিন্তু ইহুদিরা দীর্ঘকাল ধরেই বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বাস করছে। নিজ বাসভূমির বাস্তবায়নের কথা ভাবতে গিয়ে তারা দাবি করতে শুরু করে এক কালে বহু হাজার বছর আগে তারা প্যালেস্টাইনে বাস করত। অতএব প্যালেস্টাইনের ভূখণ্ডের ওপর তাদের অধিকার রয়েছে। এই দাবিতে সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোর সহযোগিতায় তারা ফিলিস্তিন দখল করে সেখানে ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে। আধুনিক কালের জাতীয়তাবাদী যুগেই ইহুদি জাতীয়তাবাদ বা জায়নবাদের উদ্ভব, বিকাশ ও শক্তিবৃদ্ধি।
জায়নবাদ কথাটা আমরা শুনি, কিন্তু অধিকাংশই বুঝি না ব্যাপারটা আসলে কী। অন্যের ভূখণ্ড দখল করা ও সেই ভূখণ্ডের আদি অধিবাসীদের বিতাড়িত করবার পক্ষে যুক্তি লাগে। তো জাতিবাদী ইহুদিরা দাবি করে তাদের ধর্মগ্রন্থ অনুযায়ী আল্লাহর সঙ্গে তাদের একটা চুক্তি হয়েছে, সেই চুক্তি অনুযায়ী, ফিলিস্তিনের একটি ভূখণ্ড আল্লাহ শুধু তাদের জন্যই বরাদ্দ করেছেন। সেটাই ইসরায়েল। তো এই ভূখণ্ডে তাদের বসতি স্থাপন ও একটি আধুনিক রাষ্ট্র বানাতে দিতে হবে। সাম্রাজ্যবাদের সহায়তায় তারা তাই করেছে।
জায়নবাদীরা এটাও দাবি করে বনী-ইস্রাইল বা ইহুদিরা বিশেষ একটি ‘জাতি’ এবং এই জাতিকে আল্লাহ ‘বিশেষভাবে মনোনীত’ করেছেন। আল্লাহ তাদের বিনা শর্তে ইহকালে এবং পরকালের শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন। অন্য যে কোন জাতির চেয়ে তারা শ্রেষ্ঠ এবং অন্যান্য জাতি তাদের তুলনায় হীন। ফলে, অন্যসকল মানুষের চেয়ে তাদের মর্যাদা আলাদা। পাপ-পুণ্যের হিসাবও তাদের জন্য আলাদা। ইহুদিরা ছাড়া অন্য কেউই আল্লাহর কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয়। শুধু জন্মসূত্রে ইহুদি হবার কারণেই তারা যা কিছুই করুক না কেন পরকালের সকল পুরষ্কার শুধু তাদেরই প্রাপ্য। তারা সুদ খাক, পাপ করুক কিম্বা অন্যের ওপর অত্যাচার নির্যাতন করুক তাদের ক্ষেত্রে আল্লাহর শাস্তির বিধানও আলাদা।
বলাবাহুল্য, আল্লাহর সঙ্গে কোন জাতির এরকম চুক্তি হয়েছে, কিম্বা আল্লাহ কোন বিশেষ জাতিকে অন্য সকল মানুষকে বাদ দিয়ে বিশেষ কোন প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন এটা ধর্মতত্ত্ব হিসাবে থাকতেই পারে। তার ভাল মন্দ বিচারও ভিন্ন বিষয়। তাছাড়া একই কথার ভিন্ন মানে বা ভিন্ন ব্যাখ্যাও হতে পারে। আর এমন অনেক গোঁড়া ইহুদিও আছেন যারা জাতীয়তাবাদী বা জায়নবাদী ইহুদির সঙ্গে মোটেও একমত নন। হজরত মুসার অনুসারী হওয়া আর জাতীয়তাবাদী ইহুদি হওয়া এক কথা নয়। মুশকিল হচ্ছে এ চুক্তি বা প্রতিশ্রুতি রাজনৈতিক কর্মসূচি ও সাম্রাজ্যবাদী প্রকল্প হিসাবে জায়নবাদীরা আরব ভূখণ্ডে বাস্তবায়িত করেছে। ফলে এক দুঃসহ নতুন বিশ্ব পরিস্থিতি তৈরী হয়েছে। ইসরাইল সেই পরিস্থিতিকে বারবারই অগ্নিগর্ভ করে তুলেছে।
তাহলে বুঝতে হবে জায়নবাদ আর জাতীয়তাবাদ একই কথা সেটা বাঙালি বা বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ হোক কিম্বা হোক মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ বা অন্য যে কোন নামের জাতীয়তাবাদ। বাঙালি বা বাংলাদেশী বলে বাংলাদেশ নামক ভূখণ্ডের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক চিরকালীন ও অবিচ্ছেদ্য এই মতাদর্শ জায়নবাদ থেকে আলাদা কিছু নয়। আধুনিক ও তথাকথিত সেকুলার কালে জায়নবাদে জাতীয়তাবাদের এই ধর্মীয় রূপটাই আমরা প্রত্যক্ষ করি। পার্থক্য হচ্ছে জায়নবাদ দাবি করে, আল্লাহর সঙ্গে ইহুদি জাতির একটা ‘চুক্তি’ হয়েছে, অতএব ফিলিস্তিনে ইহুদি জাতিসত্তার পূর্ণ বিকাশের জন্য ইহুদিদের নিয়ে একটি ইহুদি রাষ্ট্র কায়েম করতেই হবে, এর বিরুদ্ধে কোন ইহলৌকিক বা সেকুলার যুক্তি খাটবে না। অন্য কোন ধর্মের যুক্তিও খাটবে না। আমরা ধর্মের যুক্তি দেই না। কিন্তু বলি যে আমরা বাঙালি জাতি। অতএব বাঙালি জাতি হিসাবে বাংলাদেশ ভূখণ্ডে আমাদেরই একমাত্র অধিকার। জাতি হিসাবে আমাদের একটি জাতিবাদী রাষ্ট্র দরকার এর গায়ে ধর্মের পোশাক না থাকলেও জাতীয়তাবাদের জোর ধর্ম বিশ্বাসের মতোই।
ধর্মগ্রন্থের কাহিনী অনুযায়ী ফিলিস্তিনে ইহুদি রাষ্ট্রের পক্ষে যারা দাঁড়ান, তারা মূলত জায়নবাদেরই সমর্থক। জায়নবাদের যুক্তি মেনে নিলে হিন্দুর জন্য একটি হিন্দু রাষ্ট্র, মুসলমানদের জন্য মুসলমান বা ইসলামি রাষ্ট্র, খ্রিস্টানদের জন্য খ্রিস্টান রাষ্ট্র, বৌদ্ধদের জন্য বৌদ্ধ রাষ্ট্র এই সবের পক্ষে একই সঙ্গে দাঁড়ানো হয়। মুখে বলি আর না বলি, ধর্মগ্রন্থে থাকুক বা না থাকুক, জায়নবাদ অন্য সকল ধর্মের জায়নবাদী দাবিকেই ন্যায্য করে তোলে। একই সঙ্গে একটি ভূখণ্ডের সঙ্গে একটি জাতির অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কের জাতীয়তাবাদী বয়ানকেও বটে।
আরো নানান কারণ ছাড়াও জাতীয়তাবাদ ভয়াবহ জিনিস। এর মধ্যে কমিউনিস্টদের জাতীয়তাবাদ হচ্ছে সবচেয়ে নিকৃষ্ট চরিত্রের। সশস্ত্র হোক কি নিরস্ত্র কমিউনিস্ট যে কোন নিপীড়িত জাতীর মুক্তি সংগ্রামকে নিঃশর্ত সমর্থন করে, কিন্তু কোন প্রকার কাল্পনিক ‘জাতি’ বা ‘জাতীয়তাবাদ’কে প্রশ্রয় দেয় না। বিভিন্ন দেশে কমিউনিজমের বারোটা বাজাবার ক্ষেত্রে এদের অবদান অসামান্যই বলতে হবে।
দুই.
চল্লিশ দশকের শেষ দিকে প্রত্যক্ষ ঔপনিবেশিক শাসনের অবশিষ্ট গুলোর পরিসমাপ্তি ঘটতে শুরু করে। আমাদের এ অঞ্চলে সাতচল্লিশ সালে ইংরেজ শাসনের অবসান যেমন। কিন্তু আশ্চর্য যে একই সময়ে সাম্রাজ্যবাদ নতুন কিসিমের উপনিবেশ বানাতে শুরু করে। নতুন ধরনের ‘সেটলার কলোনিয়ালিজম’। তারা ইউরোপ থেকে ইহুদি ধর্মাবলম্বীদের বিতাড়িত করে তাদের জন্য আরব ভূখণ্ডে জবরদস্তি চিরস্থায়ী আবাস বানিয়ে তাকে রাষ্ট্রের মর্যাদা দেয়। আর সেটা করতে গিয়ে ফিলিস্তিনীদের নিজ বাসভূমি থেকে বিতাড়িত করা হয়, তারা দেশান্তরী হয়। বিভিন্ন জায়গায় তাদের আশ্রয় হয় শরণার্থী শিবিরে। এই অপরাধকে ন্যায্যতা দেবার জন্য বিশ্বযুদ্ধে ইহুদিদের নির্যাতন ও গণহারে মারাকে (holocaust) অজুহাত হিসাবে খাড়া করা হয়েছে। সাদা মানুষগুলো এর আগে ইউরোপ থেকে গিয়ে উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, আফ্রিকা ইত্যাদি মহাদেশে বসতি স্থাপন করেছে। সেই মহাদেশের আদি অধিবাসীদের নিশ্চিহ্ন করে দিয়ে মহাদেশগুলো দখল করে নিয়েছে তারা। যাদের হত্যা করতে পারে নি তাদের এখনও রেখে দিয়েছে রিজার্ভে। আফ্রিকা মহাদেশের অনেককে দাস বানিয়েছে তারা। আমেরিকান ইন্ডিয়ান, মায়া, ইনকা ইত্যাদি সভ্যতাকে পৃথিবীর বুক থেকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে তারা। সে ইতিহাস বড়ই নির্মম, নিষ্ঠুর ও নৃশংস। সেই সকল হোলোকস্টের কথা ভুলে গিয়ে আজ সাম্রাজ্যবাদ শুধু ইউরোপের হোলোকস্টের কথা বলে। শুধু তাই নয়। সকল প্রকার মারণাস্ত্রে জায়নবাদী ইসরাইলকে সজ্জিত করেছে তারাই। সকল প্রকার আর্থিক, সামরিক ও কূটনৈতিক সহায়তা দিয়ে ফিলিস্তিনীদের নিজ জন্মভূমি থেকে তারা উৎখাতই শুধু করে নি, নির্মম ভাবে হত্যা করছে বছরের পর বছর। আরব দেশগুলোতে টিকিয়ে রেখেছে তাঁবেদার শাসকগোষ্ঠী। এই কঠিন পরিস্থিতিতেও ফিলিস্তিনীরা তাদের সংগ্রাম অব্যাহত রেখেছে।
ইউরোপে ইহুদিদের বিরুদ্ধে ঘৃণা চর্চার (anti-semitism) পরিণতি হিসাবে তাদের নির্যাতন ও হত্যা করা হয়। প্রশ্ন হচ্ছে, আবার সেই ইহুদি নির্যাতন ও হত্যার ঘটনাকেই সাম্রাজ্যবাদ মহিয়ান করতে চায় কেন? কারণ মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েলের স্বার্থ রা করার পেছনে তাদের জ্বালানি, অর্থনীতি ও নিরাপত্তার স্বার্থ জড়িত সন্দেহ নাই, কিন্তু একই সঙ্গে রয়েছে তাদের অতীতের জঘন্য ও ঘৃণ্য অপরাধ লুকিয়ে রাখার মতলব। যেন ইহুদি হোলকস্টের কাহিনী দিয়ে উত্তর ও দক্ষিন আমেরিকায় সংঘটিত অন্যান্য হোলকস্টের কথা ভুলিয়ে দেওয়া যায়। ইউরোপের এই সাদা মানুষগুলোই কি আদিবাসীদের নির্বিচারে হত্যা করে নি? জনগোষ্ঠির পর জনগোষ্ঠিকে কি নিশ্চিহ্ন করে দেয় নি? এই কিছুদিন আগেও কালোদের দড়িতে কি লটকিয়ে মারে নি তারা? পুড়িয়ে হত্যা করে নি? সেই সকল হোলকস্টের কী হোল? তাহলে আমাদের পরিষ্কার বুঝতে হবে দুনিয়ায় ইহুদিরাই একমাত্র নির্যাতীত জাতি নয়, অন্যান্য নির্যাতীত জাতিকে যেভাবে নিশ্চিহ্ন করা হয়েছে তাদের ইতিহাস কি আমরা কি মনে রেখেছি? ইহুদিদের ওপর নির্যাতন নিন্দনীয়। কিন্তু ইহুদি নির্যাতনের কাহিনী দিয়ে মানবেতিহাসের অন্য সকল নির্যাতনকে গৌণ ও অদৃশ্য করে ফেলা মহা অপরাধ।
আমরা ইতিহাস ভুলে যাই। ভুলে যাই তথাকথিত ‘আধুনিকতা’ বা পাশ্চাত্য সভ্যতার ইঁটপাথরগুলো তৈরি হয়েছে সেইসব মানুষের হাড় দিয়ে যাদের গায়ের রঙ ছিল কালো, বাদামি বা অন্য রঙের। বর্ণবাদ আমাদের নিজেদের কলিজাকে কয়লার কালিতে কালো করে ফেলেছে। তাই যারা ইহুদিদের রাষ্ট্রের দাবির পক্ষে দাঁড়িয়ে আজ ফিলিস্তিনী জনগণকে সেই রাষ্ট্র মেনে নেবার কথা বলেন, তারা জায়নবাদের পক্ষেই শুধু দাঁড়ান না, একই সঙ্গে তারা বর্ণবাদের পক্ষেও বটে। ফিলিস্তিনী জনগণের সংগ্রাম এই দুইয়েরই বিরুদ্ধে।
অন্য জনগোষ্ঠি নিশ্চিহ্ন হয়েছে, কিম্বা ধুঁকছে তাদের জন্য বরাদ্দ ‘রিজার্ভ’ গুলোতে। কিন্তু ফিলিস্তিনীরা দমে নি। গাজাকে কুখ্যাত প্রিজন হাউস বানাবার পরেও লড়ছে তারা। এই জন্যই আমাদের বলতে হবে, সাবাশ হামাস! গাজা থেকে প্রতিটি রকেট ছোঁড়ার অর্থ সেই সব হোলকস্টের ইতিহাস স্মরণ করিয়ে দেওয়া। আমেরিকান ইন্ডিয়ান, মায়া, ইনকা, দাস হিসাবে ধরে নিয়ে যাওয়া আমেরিকায় আফ্রিকার কালো মানুষসহ আরো অগুনতি মানুষ যাদের ইতিহাস সাম্রাজ্যবাদ মুছে ফেলতে বদ্ধপরিকর।
আমাদের বলতে হবে, সাবাশ ফিলিস্তিন! সাম্রাজ্যবাদী যুগে ‘সেটলার কলোনিয়ালিজমের বিরুদ্ধে তোমাদের লড়াই। সাম্রাজ্যবাদের হৃদপিণ্ড এখানেই। এর বিরুদ্ধে লড়াই ছাড়া জাতীয়তাবাদ, জায়নবাদ ও পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থার বিলয় ঘটিয়ে দুনিয়ার সকল মানুষের ঐক্য কায়েমের জন্য শর্ত তৈরি অসম্ভব। অন্য কোন শর্টকাট রাস্তা নাই।
দুনিয়ায় জাতীয়তাবাদী ও জায়নবাদী বহুত আছে। কিন্তু তাদের মধ্যে তারাই নিকৃষ্ট যারা প্রগতির ভান ধরে। জায়নবাদের সবচেয়ে চরম বিকার এদের মধ্যেই আপাদমস্তক দৃশ্যমান হয়। নিজেদের পোষা মতাদর্শের সঙ্গে মিলে না বলে এরাই নিপীড়িত জনগোষ্ঠির ন্যায্য যুদ্ধের বিপক্ষে দাঁড়ায়।
এই যুগ ভণ্ড, কাপুরুষ, নিপীড়ক ও জালিম বিশ্বব্যবস্থার ধ্বজাধারীদের যুগ নয়। এই যুগ সৎ, পরিচ্ছন্ন ও সাহসীদের যুগ। যারা কোনপ্রকার দোদুল্যমানতা ছাড়া হুংকার দিয়ে বলতে পারে সাবাশ ফিলিস্তিন। সাবাশ হামাস, সাবাশ দুনিয়ার যে যেখানে জালিমের বিরুদ্ধে মজলুমের পক্ষে লড়ছে। লড়বে।
আবারও বলি সাবাশ ফিলিস্তিন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে তোমরা আমাদের পাশে ছিলে, সকল জাতীয়তাবাদী ও জায়নবাদী সংকীর্ণতা ছিন্ন করে বাংলাদেশের বীর ছেলেরা তোমাদের জন্য রক্ত দিয়েছে, শহিদ হয়েছে। আমরা তোমাদের পাশে আছি। থাকব।
১৭ জুলাই ২০১৪। ২ শ্রাবণ ১৪২১। শ্যামলী।
farhadmazhar@hotmail.com
এ লেখা যখন লিখছি তখন গাজায় নয়দিনে ইসরাইলের বোমা হামলায় কমপক্ষে ২২৬ জন মারা গিয়েছে, আহত হয়েছে ১৬৮৫। এদের অধিকাংশই সাধারণ মানুষ। নিহতদের মধ্যে রয়েছে শিশু ও নারী। সারে সারে কফিন দিয়ে মোড়ানো শিশুদের লাশ সারা দুনিয়ায় মানুষের বিবেককে আহত ও সংবেদনা জাগ্রত করেছে। ইসরাইলের বিরুদ্ধে তীব্র ক্ষোভ সৃষ্টি করেছে। মানুষ নিন্দা জানাচ্ছে নানান ভাবে। বাংলাদেশ ব্যতিক্রম নয়।
কিন্তু ‘গাজায় হত্যা বন্ধ কর’, ‘শিশু হত্যা বন্ধ কর’, ‘Stop Killing in Gaza’, ‘Stop Killing Children’, এইসব প্লাকার্ড হাতে বাংলাদেশে এবং বিভিন্ন দেশে ভদ্রলোকী শ্লোগান দিয়ে শহরের নিরাপদ রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে হাজার চেঁচামেচি করলেও ইসরাইল বিন্দুমাত্র তোয়াক্কা করবে না, করছে না, এবং তাদের বোমা মারাও থামবে না। অতীতেও ইসরাইল তোয়াক্কা করে নি, এখনও করবে না। আজকের খবর হচ্ছে সাময়িক যুদ্ধ বিরতিতে দুই পই সম্মত হয়েছে। কিন্তু সেটা সাময়িক। যুদ্ধ শুরুর আগে ফিলিস্তিনে যে অবস্থা থাকে তাকে এক হিসাবে লম্বা যুদ্ধবিরতি বলা চলে। এই বাস্তবতা মনে রেখেই ফিলিস্তিনের আলোচনা করতে হবে।
ফিলিস্তিন ও সমগ্র মধ্যপ্রাচ্যে যা ঘটছে তাকে সরলীকরণ করে বোঝার চেষ্টা বোকামি। কিন্তু সাধ্য মতো চেষ্টা করা আমাদের জন্য খুবই জরুরী। ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠছে যে মধ্যপ্রাচ্যের ঘটনাবলীর কোন প্রকট প্রতিক্রিয়া বাংলাদেশে না ঘটলেও তার প্রভাব গভীর। বাংলাদেশ বিশ্বসভা থেকে বিচ্ছিন্ন কোনো দ্বীপ নয়। বাংলাদেশের আগামি দিনের রাজনীতি নানা ভাবে মধ্যপ্রাচ্যের ঘটনাবলীর দ্বারা প্রভাবিত হবে। আগামি আলোচনার সূত্র হিসাবে আজ শুধু কিছু বিষয় উত্থাপন করে রাখব। গাজায় ইসরাইলী হামলার যারা প্রতিবাদ জানাচ্ছেন, তাদের প্রতি সংহতি জানানোই মূল উদ্দেশ্য। সেটা করতে গিয়ে ফিলিস্তিনীদের প্রতি আমাদের একাত্মতার জায়গাটুকু খানিক সাফ করে রাখবার চেষ্টা করব।
এটা পরিষ্কার যারা প্লাকার্ড হাতে প্রতিবাদ করছেন তারা তাঁদের ব্যক্তিগত বিবেকের তাড়া থেকে করছেন। ব্যক্তির দায়বোধ গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশ থেকে এর বেশী কিছু করার আছে কিনা সেটা এই দায়বোধে রাস্তায় প্লাকার্ড ও ব্যানার হাতে দাঁড়ানোর মধ্য দিয়ে ভাববার একটা পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, সেটাও কম নয়। নিদেন পক্ষে ফিলিস্তিন নিয়ে আমাদের আরো গভীর ভাবে ভাববার উৎসাহ বাড়বে।
তবে জেনে হোক বা না জেনে হোক, যখন আমরা শুধু শান্তি, অস্ত্র বিরতি, ও সদর্থে হত্যার নিন্দা করি, তখন আমরা ফিলিস্তিনী জনগণের মুক্তি সংগ্রামের বিরুদ্ধে দাঁড়াই এবং তাদের ন্যায়সঙ্গত সশস্ত্র যুদ্ধকে ‘ক্রিমিনালাইজ’ করার শর্ত তৈরি করি। শান্তি, অহিংসা ও যুদ্ধ বিরতির কথা বলে বাংলাদেশের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধেও অনেক ভদ্রলোকী বয়ান ছিল। তাদের কথা শুনলে আমরা আজও পাকিস্তানের উপনিবেশ থাকতাম। ইসরাইলের বোমা হামলা ও হত্যাযজ্ঞের নিন্দা করলেও, হামাসসহ ফিলিস্তিনীদের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে আমরা নীরব। অথচ দরকার মুক্তিযুদ্ধের প্রতি একাত্মতা জানানো। সেই যুদ্ধে যারা নেতৃত্ব দিচ্ছেন, তাদের সম্পর্কে আমাদের অনেক ভুল ধারণা আছে। পাশ্চাত্য প্রচার প্রপাগান্ডার শিকার হয়ে আছি অনেকেই। এই পরিস্থিতি থেকে মুক্ত হওয়া দরকার। আপাতত মনে রাখা দরকার হামাস গাজায় গণতান্ত্রিক ভাবে নির্বাচিত রাজনৈতিক কর্তৃত্ব। দুই হাজার সাত সাল থেকেই হামাস গাজার নির্বাচিত প্রতিনিধি। ফিলিস্তিন পার্লামেন্টে ২০০৬ সালে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোট পেয়ে হামাস আল ফাতাহকে পরাজিত করে। সেই থেকে তারাই কর্তৃত্বের আসনে আছেন।
এ কারণে ইসরাইল ও তাদের স্বার্থ সংরক্ষক রাষ্ট্রগুলোর মানদণ্ড দিয়ে হামাসকে বিচার করা যাবে না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, মিশর, জর্দান ও ইউরোপের অল্প কয়েকটি রাষ্ট্র ছাড়া হামাসকে নেতিবাচক ভাবে অন্য কেউ দেখে না। তাদের মধ্যে চিন, রাশিয়া, তুরস্ক ছাড়াও অনেক আরব দেশ রয়েছে। ফিলিস্তিনী জনগণ কিভাবে কাদের নেতৃত্বে তাদের ন্যায়সঙ্গত লড়াই চালিয়ে যাবে সেটা তাদের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। তারপরও হামাসের সমালোচনা হতে পারে। অবশ্যই। কিন্তু যারা ইসরাইলের নিন্দা করছেন তারাই আবার ইসরাইলী প্রপাগান্ডার কারণে হামাসকে ‘সন্ত্রাসী’ সংগঠন বলছেন। তারা আসলে গাজার ফিলিস্তিনীদেরই মূলত সন্ত্রাসী বলছেন, কারণ এই ফিলিস্তিনীরাই হামাসকে তাদের রাজনৈতিক কর্তৃত্ব হিসাবে মেনে নিয়েছে। ফিলিস্তিনীরা জাতিগত ভাবেই ‘সন্ত্রাসী’ সেটা ইসরাইলের প্রচার। হামাসকে সন্ত্রাসী বলা মানে ইসরাইলী প্রচারে সায় দেওয়া। সেই প্রচারে সায় দিয়ে গাজায় বোমা হামলা ও শিশু হত্যার নিন্দা তামাশা হয়ে যায়। যারা মরছে তারা তো ইসরাইলের যুক্তি অনুসারে ‘সন্ত্রাসী’ আর ইসরাইল তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতেই মূলত বোমা হামলা চালাচ্ছে। স্ববিরোধী অবস্থান নিয়ে গাজার হামলার বিরুদ্ধে দাঁড়ানো ঠিক কিনা সেটা সবাইকে ভেবে দেখতে বলব।
আসলে এ লড়াইকে জায়নবাদ, জাতীয়তাবাদ ও সাম্রাজ্যবাদী যুগের ‘সেটলার কলোনিয়ালিজম’ হিশাবে বুঝতে না পারলে আমরা মারাত্মক ভুল করব। বাংলাদেশের রাজনীতির সঙ্গে এর প্রাসঙ্গিকতাও আমরা ধরতে পারব না।
আমরা উপনিবেশ সম্পর্কে জানি। কারণ আমরা ইংরেজের অধীনে ছিলাম। ইংরেজ আমাদের রাজনৈতিক ভাবে পরাধীন করেছিল সম্পদের লোভে। সেটা স্রেফ লুণ্ঠন যেমন তেমনি আইন করে জমি থেকে খাজনা পাওয়া থেকে শুরু করে, এই উপমহাদেশকে তাদের পণ্যের বাজারে পরিণত করা ইত্যাদি ছিল সেই উপনিবেশের কিছু দিক। আমাদের শ্রম শক্তিও তারা শোষণ করেছে। সাম্রাজ্যবাদের এই রূপটা আমাদের চেনা। কিন্তু উত্তর ও দক্ষিন আমেরিকা এবং অস্ট্রেলিয়ায় ইউরোপের সাদা মানুষেরা গিয়ে যখন পুরা মহাদেশ তাদের দখলে নিয়ে নিল, তখন তারা ইংরেজের মতো শুধু ঔপনিবেশিক সম্পর্কের ভিত্তিতে শোষণ করে নি। সেই মহাদেশের আদি অধিবাসীদের অধিকাংশকেই তারা নিষ্ঠুর ভাবে হত্যা করে। বহু জাতিকে সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন করে দেয়। এখনও যারা বেঁচে আছে তাদেরকে তারা তাদের নির্দিষ্ট জায়গাতে বন্দিশালার মতো ‘রিজার্ভ’ বানিয়ে অদৃশ্য করে রেখেছে। সেইসব দেশে ইউরোপীয়রা শুধু ঔপনিবেশিক শাসন কায়েম করে নি, দেশ দখল করে নিয়ে নিজেরাই সেখানে বস্তি গেড়ে বসেছে। পুরা মহাদেশ তাদের দখলে নিয়ে নিয়েছে তারা। যেসব জাতি ধ্বংস ও বিলুপ্ত হয়েছে তাদের কথা আমরা খুব একটা শুনি না। যারা এখনও ধুঁকে ধুঁকে বেঁচে আছে সেই জাতিগুলো বিলুপ্তির পথে।
এই যে স্থানীয় অধিবাসীদের উৎখাত ও হত্যা করা এবং করতে না পারলে রিজার্ভে রেখে দেওয়া আর পুরা দেশ, মহাদেশ বা ভূখণ্ড দখল করে নেওয়া একেই বলা হয় ‘সেটলার কলোনিয়ালিজম’। এ নিয়ে বিস্তর গবেষণা আছে। পাঠকদের জন্য আপাতত এই তথ্যটুকুই যথেষ্ট। উপনিবেশ স্থাপন করে বিলাতে বসে শোষণ লুণ্ঠন আর স্থানীয় অধিবাসীদের উৎখাত করে নিজেরা বসতি স্থাপন করার উপনিবেশ এই দুইয়ের মধ্যে পার্থক্য বিশাল। আমাদের অভিজ্ঞতায় সেটা নাই বলে ‘সেটলার কলোনিয়ালিজম’-এর ভয়াবহতা আমরা বুঝতে পারি না। যে কারণে ফিলিস্তিনীদের লড়াইয়ের মর্ম বুঝতেও আমরা অধিকাংশই অক্ষম। ইহুদিদের অধিকারের কথা বলতে গিয়ে অতি দরদী হয়ে যারা ইসরাইলের পাবলম্বন করার অর্থ সেটলার কলোনিয়ালিজমের পক্ষে বলা। এই ধরনের উপনিবেশীকরণের যারা শিকার তারা যখন সেই ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে জানপরান লড়ে তার গুরুত্ব ও তাৎপর্য আমরা বুঝি না। বুঝি না বলেই তাদের ন্যায়যুদ্ধকে অতি অনায়াসে ‘সন্ত্রাস’ বলতে আমাদের বাঁধে না।
ইউরোপ থেকে ইহুদি ধর্মাবলম্বীরা যখন পাশ্চাত্যের সাম্রাজ্যবাদী শক্তির সহায়তায় ফিলিস্তিনীদের ভূমি দখল করে নিল আর সেটাকেই তাদের ভূখণ্ড দাবি করে ফিলিস্তিনীদের তাড়িয়ে দিল সেটা অবশ্য নতুন ধরনের সেটলার কলোনিয়ালিজম। কারণ সেটা সম্ভব হয়েছে সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর প্রত্য সহায়তায়। অতীতের সেটলার কলোনিয়ালিজমের সঙ্গে এখানে তার পার্থক্য আছে। ফিলিস্তিনীদের তাহলে শুধু ইহুদিবাদী ইসরাইল রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে লড়লে হচ্ছে না, সেটলার কলোনিয়ালিজমের বিরুদ্ধে তাদের লড়াই একই সঙ্গে সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াই হয়ে উঠেছে। এ এক অসম ও অসম্ভব যুদ্ধ। আর সে কারণেই অতীতের যে কোন গণযুদ্ধের চেয়ে ফিলিস্তিনীদের লড়াই মানবেতিহাসের সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ও দুনিয়ার সকল মানুষের ঐতিহাসিক অভিমুখ নতুন করে নির্ণয়ের লড়াই।
এরপর রয়েছে জায়নিজম (zionism) বা জায়নবাদ। প্রথমত বুঝতে হবে জায়নবাদ হচ্ছে ইহুদি জাতীয়তাবাদ। জাতীয়তাবাদ থেকে সে আলাদা কিছু না। জায়নবাদীরাও তাদের সংগ্রামকে জাতীয় মুক্তি সংগ্রামই বলে। ইউরোপে অত্যাচারিত ও নিপীড়িত ইহুদিদের পক্ষে দাঁড়ানো ও তাদের অধিকারের জন্য লড়াই সে কারণে ন্যায্য। কিন্তু নিপীড়িত জনগোষ্ঠির পক্ষে দাঁড়ানো আর জায়নবাদের পক্ষে দাঁড়ানো এক কথা নয়।
জাতীয়তাবাদ তার আত্মপরিচয়কে ভূমিসংশ্লিষ্ট দেখে। মাতৃভূমি জাতীয়তাবাদের খুবই গুরুত্বপূর্ণ ধারণা। বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ইহুদিরাও সেই অনুপ্রেরণায় নিজেদের জন্য একটি বাসভূমি (homeland) বা দেশের স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। কিন্তু ইহুদিরা দীর্ঘকাল ধরেই বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বাস করছে। নিজ বাসভূমির বাস্তবায়নের কথা ভাবতে গিয়ে তারা দাবি করতে শুরু করে এক কালে বহু হাজার বছর আগে তারা প্যালেস্টাইনে বাস করত। অতএব প্যালেস্টাইনের ভূখণ্ডের ওপর তাদের অধিকার রয়েছে। এই দাবিতে সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোর সহযোগিতায় তারা ফিলিস্তিন দখল করে সেখানে ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে। আধুনিক কালের জাতীয়তাবাদী যুগেই ইহুদি জাতীয়তাবাদ বা জায়নবাদের উদ্ভব, বিকাশ ও শক্তিবৃদ্ধি।
জায়নবাদ কথাটা আমরা শুনি, কিন্তু অধিকাংশই বুঝি না ব্যাপারটা আসলে কী। অন্যের ভূখণ্ড দখল করা ও সেই ভূখণ্ডের আদি অধিবাসীদের বিতাড়িত করবার পক্ষে যুক্তি লাগে। তো জাতিবাদী ইহুদিরা দাবি করে তাদের ধর্মগ্রন্থ অনুযায়ী আল্লাহর সঙ্গে তাদের একটা চুক্তি হয়েছে, সেই চুক্তি অনুযায়ী, ফিলিস্তিনের একটি ভূখণ্ড আল্লাহ শুধু তাদের জন্যই বরাদ্দ করেছেন। সেটাই ইসরায়েল। তো এই ভূখণ্ডে তাদের বসতি স্থাপন ও একটি আধুনিক রাষ্ট্র বানাতে দিতে হবে। সাম্রাজ্যবাদের সহায়তায় তারা তাই করেছে।
জায়নবাদীরা এটাও দাবি করে বনী-ইস্রাইল বা ইহুদিরা বিশেষ একটি ‘জাতি’ এবং এই জাতিকে আল্লাহ ‘বিশেষভাবে মনোনীত’ করেছেন। আল্লাহ তাদের বিনা শর্তে ইহকালে এবং পরকালের শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন। অন্য যে কোন জাতির চেয়ে তারা শ্রেষ্ঠ এবং অন্যান্য জাতি তাদের তুলনায় হীন। ফলে, অন্যসকল মানুষের চেয়ে তাদের মর্যাদা আলাদা। পাপ-পুণ্যের হিসাবও তাদের জন্য আলাদা। ইহুদিরা ছাড়া অন্য কেউই আল্লাহর কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয়। শুধু জন্মসূত্রে ইহুদি হবার কারণেই তারা যা কিছুই করুক না কেন পরকালের সকল পুরষ্কার শুধু তাদেরই প্রাপ্য। তারা সুদ খাক, পাপ করুক কিম্বা অন্যের ওপর অত্যাচার নির্যাতন করুক তাদের ক্ষেত্রে আল্লাহর শাস্তির বিধানও আলাদা।
বলাবাহুল্য, আল্লাহর সঙ্গে কোন জাতির এরকম চুক্তি হয়েছে, কিম্বা আল্লাহ কোন বিশেষ জাতিকে অন্য সকল মানুষকে বাদ দিয়ে বিশেষ কোন প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন এটা ধর্মতত্ত্ব হিসাবে থাকতেই পারে। তার ভাল মন্দ বিচারও ভিন্ন বিষয়। তাছাড়া একই কথার ভিন্ন মানে বা ভিন্ন ব্যাখ্যাও হতে পারে। আর এমন অনেক গোঁড়া ইহুদিও আছেন যারা জাতীয়তাবাদী বা জায়নবাদী ইহুদির সঙ্গে মোটেও একমত নন। হজরত মুসার অনুসারী হওয়া আর জাতীয়তাবাদী ইহুদি হওয়া এক কথা নয়। মুশকিল হচ্ছে এ চুক্তি বা প্রতিশ্রুতি রাজনৈতিক কর্মসূচি ও সাম্রাজ্যবাদী প্রকল্প হিসাবে জায়নবাদীরা আরব ভূখণ্ডে বাস্তবায়িত করেছে। ফলে এক দুঃসহ নতুন বিশ্ব পরিস্থিতি তৈরী হয়েছে। ইসরাইল সেই পরিস্থিতিকে বারবারই অগ্নিগর্ভ করে তুলেছে।
তাহলে বুঝতে হবে জায়নবাদ আর জাতীয়তাবাদ একই কথা সেটা বাঙালি বা বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ হোক কিম্বা হোক মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ বা অন্য যে কোন নামের জাতীয়তাবাদ। বাঙালি বা বাংলাদেশী বলে বাংলাদেশ নামক ভূখণ্ডের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক চিরকালীন ও অবিচ্ছেদ্য এই মতাদর্শ জায়নবাদ থেকে আলাদা কিছু নয়। আধুনিক ও তথাকথিত সেকুলার কালে জায়নবাদে জাতীয়তাবাদের এই ধর্মীয় রূপটাই আমরা প্রত্যক্ষ করি। পার্থক্য হচ্ছে জায়নবাদ দাবি করে, আল্লাহর সঙ্গে ইহুদি জাতির একটা ‘চুক্তি’ হয়েছে, অতএব ফিলিস্তিনে ইহুদি জাতিসত্তার পূর্ণ বিকাশের জন্য ইহুদিদের নিয়ে একটি ইহুদি রাষ্ট্র কায়েম করতেই হবে, এর বিরুদ্ধে কোন ইহলৌকিক বা সেকুলার যুক্তি খাটবে না। অন্য কোন ধর্মের যুক্তিও খাটবে না। আমরা ধর্মের যুক্তি দেই না। কিন্তু বলি যে আমরা বাঙালি জাতি। অতএব বাঙালি জাতি হিসাবে বাংলাদেশ ভূখণ্ডে আমাদেরই একমাত্র অধিকার। জাতি হিসাবে আমাদের একটি জাতিবাদী রাষ্ট্র দরকার এর গায়ে ধর্মের পোশাক না থাকলেও জাতীয়তাবাদের জোর ধর্ম বিশ্বাসের মতোই।
ধর্মগ্রন্থের কাহিনী অনুযায়ী ফিলিস্তিনে ইহুদি রাষ্ট্রের পক্ষে যারা দাঁড়ান, তারা মূলত জায়নবাদেরই সমর্থক। জায়নবাদের যুক্তি মেনে নিলে হিন্দুর জন্য একটি হিন্দু রাষ্ট্র, মুসলমানদের জন্য মুসলমান বা ইসলামি রাষ্ট্র, খ্রিস্টানদের জন্য খ্রিস্টান রাষ্ট্র, বৌদ্ধদের জন্য বৌদ্ধ রাষ্ট্র এই সবের পক্ষে একই সঙ্গে দাঁড়ানো হয়। মুখে বলি আর না বলি, ধর্মগ্রন্থে থাকুক বা না থাকুক, জায়নবাদ অন্য সকল ধর্মের জায়নবাদী দাবিকেই ন্যায্য করে তোলে। একই সঙ্গে একটি ভূখণ্ডের সঙ্গে একটি জাতির অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কের জাতীয়তাবাদী বয়ানকেও বটে।
আরো নানান কারণ ছাড়াও জাতীয়তাবাদ ভয়াবহ জিনিস। এর মধ্যে কমিউনিস্টদের জাতীয়তাবাদ হচ্ছে সবচেয়ে নিকৃষ্ট চরিত্রের। সশস্ত্র হোক কি নিরস্ত্র কমিউনিস্ট যে কোন নিপীড়িত জাতীর মুক্তি সংগ্রামকে নিঃশর্ত সমর্থন করে, কিন্তু কোন প্রকার কাল্পনিক ‘জাতি’ বা ‘জাতীয়তাবাদ’কে প্রশ্রয় দেয় না। বিভিন্ন দেশে কমিউনিজমের বারোটা বাজাবার ক্ষেত্রে এদের অবদান অসামান্যই বলতে হবে।
দুই.
চল্লিশ দশকের শেষ দিকে প্রত্যক্ষ ঔপনিবেশিক শাসনের অবশিষ্ট গুলোর পরিসমাপ্তি ঘটতে শুরু করে। আমাদের এ অঞ্চলে সাতচল্লিশ সালে ইংরেজ শাসনের অবসান যেমন। কিন্তু আশ্চর্য যে একই সময়ে সাম্রাজ্যবাদ নতুন কিসিমের উপনিবেশ বানাতে শুরু করে। নতুন ধরনের ‘সেটলার কলোনিয়ালিজম’। তারা ইউরোপ থেকে ইহুদি ধর্মাবলম্বীদের বিতাড়িত করে তাদের জন্য আরব ভূখণ্ডে জবরদস্তি চিরস্থায়ী আবাস বানিয়ে তাকে রাষ্ট্রের মর্যাদা দেয়। আর সেটা করতে গিয়ে ফিলিস্তিনীদের নিজ বাসভূমি থেকে বিতাড়িত করা হয়, তারা দেশান্তরী হয়। বিভিন্ন জায়গায় তাদের আশ্রয় হয় শরণার্থী শিবিরে। এই অপরাধকে ন্যায্যতা দেবার জন্য বিশ্বযুদ্ধে ইহুদিদের নির্যাতন ও গণহারে মারাকে (holocaust) অজুহাত হিসাবে খাড়া করা হয়েছে। সাদা মানুষগুলো এর আগে ইউরোপ থেকে গিয়ে উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, আফ্রিকা ইত্যাদি মহাদেশে বসতি স্থাপন করেছে। সেই মহাদেশের আদি অধিবাসীদের নিশ্চিহ্ন করে দিয়ে মহাদেশগুলো দখল করে নিয়েছে তারা। যাদের হত্যা করতে পারে নি তাদের এখনও রেখে দিয়েছে রিজার্ভে। আফ্রিকা মহাদেশের অনেককে দাস বানিয়েছে তারা। আমেরিকান ইন্ডিয়ান, মায়া, ইনকা ইত্যাদি সভ্যতাকে পৃথিবীর বুক থেকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে তারা। সে ইতিহাস বড়ই নির্মম, নিষ্ঠুর ও নৃশংস। সেই সকল হোলোকস্টের কথা ভুলে গিয়ে আজ সাম্রাজ্যবাদ শুধু ইউরোপের হোলোকস্টের কথা বলে। শুধু তাই নয়। সকল প্রকার মারণাস্ত্রে জায়নবাদী ইসরাইলকে সজ্জিত করেছে তারাই। সকল প্রকার আর্থিক, সামরিক ও কূটনৈতিক সহায়তা দিয়ে ফিলিস্তিনীদের নিজ জন্মভূমি থেকে তারা উৎখাতই শুধু করে নি, নির্মম ভাবে হত্যা করছে বছরের পর বছর। আরব দেশগুলোতে টিকিয়ে রেখেছে তাঁবেদার শাসকগোষ্ঠী। এই কঠিন পরিস্থিতিতেও ফিলিস্তিনীরা তাদের সংগ্রাম অব্যাহত রেখেছে।
ইউরোপে ইহুদিদের বিরুদ্ধে ঘৃণা চর্চার (anti-semitism) পরিণতি হিসাবে তাদের নির্যাতন ও হত্যা করা হয়। প্রশ্ন হচ্ছে, আবার সেই ইহুদি নির্যাতন ও হত্যার ঘটনাকেই সাম্রাজ্যবাদ মহিয়ান করতে চায় কেন? কারণ মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েলের স্বার্থ রা করার পেছনে তাদের জ্বালানি, অর্থনীতি ও নিরাপত্তার স্বার্থ জড়িত সন্দেহ নাই, কিন্তু একই সঙ্গে রয়েছে তাদের অতীতের জঘন্য ও ঘৃণ্য অপরাধ লুকিয়ে রাখার মতলব। যেন ইহুদি হোলকস্টের কাহিনী দিয়ে উত্তর ও দক্ষিন আমেরিকায় সংঘটিত অন্যান্য হোলকস্টের কথা ভুলিয়ে দেওয়া যায়। ইউরোপের এই সাদা মানুষগুলোই কি আদিবাসীদের নির্বিচারে হত্যা করে নি? জনগোষ্ঠির পর জনগোষ্ঠিকে কি নিশ্চিহ্ন করে দেয় নি? এই কিছুদিন আগেও কালোদের দড়িতে কি লটকিয়ে মারে নি তারা? পুড়িয়ে হত্যা করে নি? সেই সকল হোলকস্টের কী হোল? তাহলে আমাদের পরিষ্কার বুঝতে হবে দুনিয়ায় ইহুদিরাই একমাত্র নির্যাতীত জাতি নয়, অন্যান্য নির্যাতীত জাতিকে যেভাবে নিশ্চিহ্ন করা হয়েছে তাদের ইতিহাস কি আমরা কি মনে রেখেছি? ইহুদিদের ওপর নির্যাতন নিন্দনীয়। কিন্তু ইহুদি নির্যাতনের কাহিনী দিয়ে মানবেতিহাসের অন্য সকল নির্যাতনকে গৌণ ও অদৃশ্য করে ফেলা মহা অপরাধ।
আমরা ইতিহাস ভুলে যাই। ভুলে যাই তথাকথিত ‘আধুনিকতা’ বা পাশ্চাত্য সভ্যতার ইঁটপাথরগুলো তৈরি হয়েছে সেইসব মানুষের হাড় দিয়ে যাদের গায়ের রঙ ছিল কালো, বাদামি বা অন্য রঙের। বর্ণবাদ আমাদের নিজেদের কলিজাকে কয়লার কালিতে কালো করে ফেলেছে। তাই যারা ইহুদিদের রাষ্ট্রের দাবির পক্ষে দাঁড়িয়ে আজ ফিলিস্তিনী জনগণকে সেই রাষ্ট্র মেনে নেবার কথা বলেন, তারা জায়নবাদের পক্ষেই শুধু দাঁড়ান না, একই সঙ্গে তারা বর্ণবাদের পক্ষেও বটে। ফিলিস্তিনী জনগণের সংগ্রাম এই দুইয়েরই বিরুদ্ধে।
অন্য জনগোষ্ঠি নিশ্চিহ্ন হয়েছে, কিম্বা ধুঁকছে তাদের জন্য বরাদ্দ ‘রিজার্ভ’ গুলোতে। কিন্তু ফিলিস্তিনীরা দমে নি। গাজাকে কুখ্যাত প্রিজন হাউস বানাবার পরেও লড়ছে তারা। এই জন্যই আমাদের বলতে হবে, সাবাশ হামাস! গাজা থেকে প্রতিটি রকেট ছোঁড়ার অর্থ সেই সব হোলকস্টের ইতিহাস স্মরণ করিয়ে দেওয়া। আমেরিকান ইন্ডিয়ান, মায়া, ইনকা, দাস হিসাবে ধরে নিয়ে যাওয়া আমেরিকায় আফ্রিকার কালো মানুষসহ আরো অগুনতি মানুষ যাদের ইতিহাস সাম্রাজ্যবাদ মুছে ফেলতে বদ্ধপরিকর।
আমাদের বলতে হবে, সাবাশ ফিলিস্তিন! সাম্রাজ্যবাদী যুগে ‘সেটলার কলোনিয়ালিজমের বিরুদ্ধে তোমাদের লড়াই। সাম্রাজ্যবাদের হৃদপিণ্ড এখানেই। এর বিরুদ্ধে লড়াই ছাড়া জাতীয়তাবাদ, জায়নবাদ ও পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থার বিলয় ঘটিয়ে দুনিয়ার সকল মানুষের ঐক্য কায়েমের জন্য শর্ত তৈরি অসম্ভব। অন্য কোন শর্টকাট রাস্তা নাই।
দুনিয়ায় জাতীয়তাবাদী ও জায়নবাদী বহুত আছে। কিন্তু তাদের মধ্যে তারাই নিকৃষ্ট যারা প্রগতির ভান ধরে। জায়নবাদের সবচেয়ে চরম বিকার এদের মধ্যেই আপাদমস্তক দৃশ্যমান হয়। নিজেদের পোষা মতাদর্শের সঙ্গে মিলে না বলে এরাই নিপীড়িত জনগোষ্ঠির ন্যায্য যুদ্ধের বিপক্ষে দাঁড়ায়।
এই যুগ ভণ্ড, কাপুরুষ, নিপীড়ক ও জালিম বিশ্বব্যবস্থার ধ্বজাধারীদের যুগ নয়। এই যুগ সৎ, পরিচ্ছন্ন ও সাহসীদের যুগ। যারা কোনপ্রকার দোদুল্যমানতা ছাড়া হুংকার দিয়ে বলতে পারে সাবাশ ফিলিস্তিন। সাবাশ হামাস, সাবাশ দুনিয়ার যে যেখানে জালিমের বিরুদ্ধে মজলুমের পক্ষে লড়ছে। লড়বে।
আবারও বলি সাবাশ ফিলিস্তিন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে তোমরা আমাদের পাশে ছিলে, সকল জাতীয়তাবাদী ও জায়নবাদী সংকীর্ণতা ছিন্ন করে বাংলাদেশের বীর ছেলেরা তোমাদের জন্য রক্ত দিয়েছে, শহিদ হয়েছে। আমরা তোমাদের পাশে আছি। থাকব।
১৭ জুলাই ২০১৪। ২ শ্রাবণ ১৪২১। শ্যামলী।
farhadmazhar@hotmail.com
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন