যখন থেকেই এই জগত্ সংসার শুরু তখন থেকেই শুরু মতের অমিল বা চিন্তার ভিন্নতা। আল্লাহ যখন চাইলেন এই দুনিয়ায় মানুষ প্রেরণ করবেন তখন ফেরেশতারা দ্বিমত পোষণ করে বসলেন এই বলে যে, হে খোদা! আমরাই তো তোমার ইবাদত-বন্দেগি করার জন্য যথেষ্ট, আবার মানুষ কেন? আদমপুত্র হাবিল-কাবিলের মধ্যে চিন্তার অমিল ছিল। বিয়ের প্রশ্নে হজরত আদমের সিদ্ধান্তের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে তারা। সেই পুরনো যুগ থেকে আজ পর্যন্ত মানুষে মানুষে মতবিরোধ চলে আসছে। এই মতপার্থক্য অবধারিত। এর থেকে বাঁচার কোনো উপায় নেই। বলা হয়, ‘মৃতরা মতবিরোধ করে না, যেখানে জীবন আছে সেখানে মতদ্বৈধতা আছে।’
আল্লাহতায়ালা আমাদের বহু রূপে, বহু গুণে সৃষ্টি করেছেন। এক ব্যক্তি থেকে আরেক ব্যক্তির মধ্যে অনেক ব্যবধান রেখেছেন। সেই ব্যবধান চিন্তার, সেই ব্যবধান রুচিবোধ ও মননের। কিন্তু তারপরও তিনি আমাদের ঐক্যবদ্ধ হতে বলেছেন আমাদের স্বার্থেই। পবিত্র কোরআনে এসেছে, ‘তোমরা আল্লাহর রজ্জুকে ঐক্যবদ্ধভাবে আঁকড়ে ধর এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না’ (সুরা আল ইমরান : ১০৩)। অথচ আমাদের মাতৃভূমি সোনার বাংলাদেশ এখন অশান্তির সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছে। এর একমাত্র কারণ জাতীয় অনৈক্য। দলে দলে বিভক্ত হয়ে পড়েছি আমরা। একে অপরের দিকে কাদা ছোড়াছুড়িতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছি। অনৈক্য তো চোখে পড়ার মতো। আলেম-উলামা, দল-মত নির্বিশেষে সবার এই অনৈক্যকে সুযোগ হিসেবে কাজে লাগিয়েছে ইসলামবিরোধী অপশক্তি। তারা ইংরেজদের নীতি ‘উরারফব ধহফ জঁষব্থ তথা ‘বিচ্ছিন্ন করে শাসন করো’কে গ্রহণ করে আমাদের তছনছ করে দিচ্ছে। আজ আল্লাহকে গালি দেয়া হচ্ছে। গালি দেয়া হচ্ছে আমাদের প্রিয় রাসুল হজরত মুহাম্মদ (সা.)কে। রাসুলের সহধর্মিণীদের চরিত্র হনন করা হচ্ছে অশ্লীল কায়দায়। কোরআন, হাদিস, মসজিদ, মাদরাসা, ইসলামি রাজনীতি, ইসলামি অর্থনীতি, ইসলামি সংস্কৃতি ও মূল্যবোধকে বিদায় করার সব আয়োজন আজ সম্পন্ন। এককথায়, তাওহিদপন্থী মুসলমানের বিরুদ্ধে বাতেল শক্তি আজ একাট্টা।
এদেশের ইসলামপন্থী শক্তির এখন সিদ্ধান্ত নিতে হবে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার। এদেশে ইসলামের পতাকা উড্ডীন রাখতে হলে সবাইকে আজ একতার শপথ গ্রহণ করতে হবে। কিন্তু কীভাবে হবে এই ঐক্য? এ বিষয়ে খোঁজ করতে গিয়ে আমরা সুন্দর একটি তত্তের সন্ধান পেয়েছি। সেই তত্ত্বটি হচ্ছে, ‘আল-ইত্তেহাদ মায়াল ইখতেলাফ’ তথা ‘মতানৈক্যসহ ঐক্য’। এই তত্ত্বটির কথা এ দেশে প্রথম উচ্চারণ করেছিলেন প্রখ্যাত আলেমে দ্বীন মাওলানা আযীযুর রহমান নেছারাবাদী কায়েদ সাহেব হুজুর (র.)। ‘মতানৈক্যসহ ঐক্য‘র তত্ত্বটি বাস্তব রূপ দিতে তিনি এদেশের আনাচে-কানাচে ঘুরেছেন। ছারছীনা, চরমোনাই, ফুরফুরা, জৌনপুরী, বায়তুশ শরফ, আটরশি, মাইজভান্ডার, তাবলীগ, জামায়াতে ইসলামীসহ অসংখ্য পীরের দরবার এবং দেশপ্রেমিক ও জাতীয়তাবাদী ইসলামি শক্তিকে ইস্যুভিত্তিক ঐক্য গড়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন। তাঁর এই ঐক্য প্রচেষ্টা শুরু হয়েছিল ১৯৫২ সালে (ঐক্যের প্রয়োজনীয়তা ও উহার পথ, পৃ. ০৩)। হজরত কায়েদ সাহেব হুজুর (র.) ঐক্যের যে রূপরেখা তুলে ধরেছেন অতি সংক্ষেপে তা হচ্ছে, দেশ-জাতি ও রাষ্ট্রের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষায় দল মত ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধ হওয়া, নাস্তিকদের বিরুদ্ধে সব আস্তিক্যবাদী শক্তির ঐক্য, ইসলামবিরোধী তত্পরতার বিরুদ্ধে সব আলেম-উলামার ঐক্য। ভণ্ড ও জালিম নির্মূলেও সবার মধ্যে সাধারণ ঐক্য হতে পারে। এই ঐক্য হবে ইস্যুভিত্তিক। ইস্যুভিত্তিক ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন করতে গিয়ে কোনো দল বা মতকে তার নিজস্ব কর্মসূচি বাদ দিতে হবে না।
যুগে যুগে ইস্যুভিত্তিক ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন যে সফলতার মুখ দেখেছে তার প্রমাণও আমরা পেয়েছি। ঈমান, ঐক্য ও শৃঙ্খলা—এ ত্রিনীতির ভিত্তিতে সংগঠিত ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের ফলেই পাকিস্তান অর্জন হয়েছিল। ১৯৫১ সালে করাচিতে শিয়া-সুন্নী নির্বিশেষে সর্বদলীয় উলামা ও মাশায়েখ সম্মেলনে সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়েছিলেন বলেই পাকিস্তানের ২২ দফা মূলনীতি রচনা করা সম্ভব হয়েছিল।
আমাদের পাশের দেশ ভারতেও আলেমদের ঐক্য প্রচেষ্টা সফলতার মুখ দেখেছে। ভারত সরকার যখন মুসলমানদের পারিবারিক বিধি-বিধান পরিবর্তন করতে চাইলো তখন বিশ্ববিখ্যাত আলেমে দ্বীন আল্লামা আবুল হাসান আলী আন-নাদভীর (র.) নেতৃত্বে ভারতের সব শ্রেণীর উলামা ও ইসলামি গ্রুপ একই প্লাটফর্মে এসে ‘অষষ ওহফরধ গঁংষরস খধ িইড়ধত্ফ্থ গঠন করে। যেখানে বেরলভী সুন্নী, দেওবন্দী, আহলে হাদিস এমনকি শিয়া মতাদর্শের আলেমরাও যুক্ত হয়ে সমগ্র ইন্ডিয়ার সাধারণ মুসলমানদের স্বার্থে ইস্যুভিত্তিক ঐক্য গড়ে সফল হয়েছেন। ইন্ডিয়ার সরকার মুসলমানদের ব্যাপারে কোনো ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে হলে এই ননগভর্নমেন্ট সংগঠনের মতামত নিতে হয়। পারভেজ মোশাররফ সরকারের আমলেও সমগ্র পাকিস্তানে আলেমদের ঐক্য সাধিত হয়েছিল। পাকিস্তানের ইসলামী সংগঠন জমিয়াতুল উলামার আমির মাওলানা ফজলুর রহমান সেই ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের প্রধান ছিলেন। যেখানে পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামীসহ সমমনা অন্যান্য দল অন্তর্ভুক্ত হয়ে পার্লামেন্টে শক্ত ভূমিকা পালন করতে সক্ষম হয়েছিল। সেই আমলে পাকিস্তান সরকার মাদরাসা শিক্ষা সংস্কারের নামে বিভিন্ন কর্মসূচি হাতে নিলে তাও আলেমরা সম্মিলিতভাবে প্রতিরোধ করেন। সেই প্রতিরোধ আন্দোলনে বেরলভী গ্রুপ, আহলে হাদিস গ্রুপ, দেওবন্দী গ্রুপ এবং শিয়া গ্রুপ নিয়ন্ত্রিত মাদরাসাগুলোর বোর্ড ঐক্যবদ্ধ হয়ে সরকারের অযাচিত হস্তক্ষেপকে প্রতিহত করে। ২০১০ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী নাজিব তুন রাজাক সংসদ, সরকার ও জনগণকে ‘ঙহব গধষধুংরধ্থ তথা এক মালয়েশিয়া কনসেপ্টকে ব্যাপকভাবে কাজে লাগিয়ে সবাইকে জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার আহ্বান জানান। ২০১০ সালে প্রায় ৩৮ মিলিয়ন ডলার ব্যয় করা হয় ‘ওয়ান মালয়েশিয়া’ কনসেপ্টকে সবার কাছে পৌঁছে দেয়ার জন্য। ‘ওয়ান মালয়েশিয়া’ কনসেপ্ট সেদেশে যাদুর মতো কাজ করে। জাতি, ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সবাই দেশ গড়ার কাজে ঐক্যবদ্ধভাবে নেমে পড়ে। ‘আরব বসন্ত’ নামে খ্যাত মিসর ও তিউনিসিয়ার বিপ্লবের পেছনেও রয়েছে সব ইসলামি সংগঠন ও আলেম-উলামার ইস্যুভিত্তিক ঐক্যের বিশাল অবদান। আরব দেশের বর্তমান ইসলামী সংগঠনগুলো এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে যে, ‘না‘মালু ফি মা ইত্তাফাকস্ফনা ওয়া নাসকুতু আম্মা ইখতালাফনা’ অর্থাত্ আমাদের মধ্যে যেসব বিষয়ের মিল আছে সেগুলো ঐক্যবদ্ধভাবে করব আর যেসব বিষয়ে ইখতেলাফ আছে সে বিষয়ে চুপ থাকব, কেউ কারো সমালোচনা করব না।
বাংলাদেশে নাস্তিক ব্লগারদের বিরুদ্ধে প্রখ্যাত আলেমে দ্বীন আল্লামা আহমদ শফী আলেমদের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। তার এই আহ্বানও যাদুর মতো কাজ করেছে। অপ্রতিরোধ্য শাহবাগিরা আত্মসমর্পণ করেছে চট্টগ্রামের তাওহিদী জনতার কাছে। অতএব নির্দ্বিধায় বলা যায়, ‘মতানৈক্যসহ ঐক্য’ একটি ফলপ্রসূ আন্দোলনের নাম। যেখানে সব মতের লোকজন তাদের নিজস্ব মত ও পথকে আঁকড়ে ধরে মুসলিম উম্মাহর মৌলিক ইস্যু কিংবা দেশ-জাতির প্রধান ইস্যুতে ঐক্য গড়ে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলতে পারে। এই ঐক্য হতে পারে নাস্তিকদের বিরুদ্ধে সব আস্তিকের, দেশের স্বাধীনতা রক্ষায় দল-মত নির্বিশেষে কিংবা ইসলামবিরোধী শক্তির বিরুদ্ধে সব ইসলামপন্থীদের।
এদেশে তাবলিগ জামাত বিশাল একটি শক্তি। বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর অবস্থানও বেশ শক্ত। ইসলামি আন্দোলন, খেলাফত মজলিসসহ অন্য ইসলামি দলগুলোরও কমবেশি শক্তি আছে। সব মিলিয়ে কওমী ধারার আলেম-উলামার প্রভাব খাটো করে দেখার কোনো সুযোগ নেই। তেমনিভাবে ছারছীনা, ফুরফুরা, চরমোনাই, ফুলতলী, জৌনপুরীসহ সুফী ধারার বিভিন্ন আধ্যাত্মিক দরবারের প্রভাবও রয়েছে দেশজুড়ে। সব ইসলামি দল ও পীর সাহেবরা যদি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন যে, এদেশে কোনো কোরআন-সুন্নাহ বিরোধী আইন পাস হতে দেয়া হবে না, আল্লাহ, রাসুল ও সাহাবীদের বিরুদ্ধে যে কোনো ষড়যন্ত্র সহ্য করা হবে না এবং কোনো ইসলামি দল কিংবা আলেমের ওপর নির্যাতন সহ্য করা হবে না তাহলে তা অবশ্যই সম্ভব। ইসলামবিরোধী তত্পরতা মোকাবিলায় ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের কোনো বিকল্প নেই। কিয়ামত পর্যন্ত মতের পার্থক্য থাকবে। আমাদের উচিত এই মতপার্থক্যকে সঙ্গে নিয়েই মৌলিক বিষয়ে ঐক্যবদ্ধ হওয়া। মনে রাখবেন, ঐক্যবদ্ধ শক্তি যত ক্ষুদ্র হোক তার বিজয় আসন্ন এবং বিচ্ছিন্ন শক্তি যত বড়ই হোক না কেন, তার পরাজয় নিশ্চিত। আল্লাহ আমাদের এ সত্যটুকু বোঝার তৌফিক দিন। আমিন!
লেখক : অধ্যাপক আমিনুল হক,বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ও কলামিস্ট
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন