মঙ্গলবার, ৫ মার্চ, ২০১৩

দাওয়ার ক্ষেত্রে ইলেক্ট্রনিক্য্র মিডিয়ার প্রয়োজনীয়তা ও আমাদের মতবাদ


        
 বিচক্ষণ তথ্যনীতি প্রবর্তন তথ্য-প্রযুক্তি আধুনিক জীবনধারায় সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে-এ কথা কারো অজানা নয়। বিশ্বময় শান্তি, শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা ও জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে যেমন এর ভূমিকা অপরিহার্য, তেমনি অশান্তি, নৈরাজ্য ও হতাশ সৃষ্টির ক্ষেত্রেও এর ভূমিকা কম দায়ী নয়। তথ্য-প্রযুক্তির বিস্ময়কর উন্নতি গোটা পৃথিবীকে আজ ‘বিশ্বগ্রামে’ রূপান্তরিত করেছে। আর তাই সাম্রাজ্যবাদী, নোংরা, অসভ্য ধ্যান-ধারণা, চিন্তা-চেতনা বিশ্বায়নের স্বপ্নে বিভোর হয়েছে আমেরিকা ও তার পাশ্চাত্য-বন্ধুরা। সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের নেশায় প্রমত্ত হয়ে তারা তথ্য ও সংবাদ মাধ্যমগুলোকে আজ মিথ্যাচারের ভারে আক্রান্ত করে বিশ্বজুড়ে নির্বিঘেœ তথ্য সন্ত্রাস চালিয়ে যাচ্ছে ইসলাম ও মুসলিমবিশ্বের বিরুদ্ধে। সম্প্রতি একযোগে ইউরোপের পত্র-পত্রিকা, প্রচার মাধ্যমে বিশ্বনবী, মানবতার মুক্তির দূত মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর ব্যঙ্গচিত্র প্রকাশ এই তথ্য সন্ত্রাসের একটি স্পষ্ট উদাহরণ। ইসলাম তথ্যাদির আদান-প্রদান, প্রচার-প্রসারের এমন কিছু নিয়ম-নীতি নির্ধারণ করে দিয়েছে, মুসলিম-অমুসলিম নির্বিশেষে গোটা মানবতার কল্যাণে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের জন্য এর কোন বিকল্প নেই। যতদিন পর্যন্ত এগুলোর প্রতি মানুষের মনে শ্রদ্ধবোধ না জাগবে, ততদিন তথ্যপ্রযুক্তি উপকার নয়, মানুষের অপকারেই ব্যবহৃত হবে। নিরাপত্তার বাণী নয়, তা সন্ত্রাসের বাণীই প্রচার করবে। কুরআনে ইরশাদ হয়েছেঃ “হে ঈমানদারগণ, আল্লাহকে ভয় কর এবং সত্যবাদীদের সাথে থাক”-(তাওবাহ:১১৯)। ছহীহ আল বুখারীতে যে দীর্ঘ হাদীসে রাসূল (সাঃ) এ স্বপ্নের বৃত্তান্ত দেয়া হয়েছে, তাতে এক জায়গায় মিথ্যা গুজব বা সংবাদ প্রচারকারীর শাস্তির ব্যাপারে রাসূলে কারীম (সাঃ) বলেনঃ “ এক শায়িত ব্যক্তির কাছে আমরা উপস্থিত হলাম । দেখলাম, এক ব্যক্তি তার পাশে দাঁড়িয়ে লোহার একটি অস্ত্র দিয়ে একবার ডানপাশের চোয়াল ও চোখ একবারে পেছন পর্যন্ত ফেড়ে দিচ্ছে। তারপর যখনই বাম দিকে অনুরূপ ফেড়ে দিচ্ছে, তখন ডাক দিকটা আগের মত স্বাভাবিক হয়ে যাচ্ছে। কিয়ামত পর্যন্ত তাকে এভাবে শাস্তি দেয়া হবে। আমি জিজ্ঞাসা করলাম: এই ব্যক্তি কে? আমার সঙ্গী ফেরেশতাদ্বয় বললেনঃ সে বাড়ী বাড়ী থেকে বেরিয়ে একটা মিথ্যে গুজব রটিয়ে ছেড়ে দিতো এবং তা চারদিকে ছড়িয়ে পড়তো” আর একটি হাদীসে রাসূল কারীম (সাঃ) বলেনঃ “মু’ মিনের স্বভাবে সব রকমের দোষ থাকা সম্ভব, কিন্তু মিথ্যা ও খেয়ানত থাকা সম্ভব নয়”সংবাদের সত্যতা যাচাই করা, নিছক ধারণার বশবর্তী না হওয়া, কারো প্রতি মিথ্যারোপণ না করাঃ  কুরআনে ইরশাদ হয়েছেঃ হে মু’মিনগণ! কোন ফাসিক তোমাদের কাছে কোন সংবাদ পরিবেশন কবে,তবে তার সত্যতা যাচাই করে নাও। এমন যেন না হয় যে অজ্ঞাতবশত কোন মানবগোষ্টির উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে যার কারণে তোমরা নিন্দিত ও লজ্জিত হবে। আল্লাহ পাক পবিত্র কোরআনে অন্য জায়গায় ইরশাদ করেছেন তুমি মানুষকে তোমার প্রতিপালকের দিকে ডাক হিকমত ও সদুপদেশ সহকারে এবং তাহাদের সঙ্গে সদ্ভাবে বিতর্ক কর (নাহল ১২৫) লক্ষনীয় বিষয় হলো এখানে দাওয়াতে ইসলামকে কোন নির্দিষ্ট বিষয়ে সীমাবদ্ধ না রেখে ব্যাপকভাবে রাখা হয়েছে। এতে দাওয়াতের সব মাধ্যম ও উপকরণ অন্তর্ভুক্ত, সুতরাং এই আয়ত অবলম্বনে এই কথা বলতে দ্বিধা নেই যে বর্তমানে প্রযুক্তির যত ধরণ হতে পারে সব কিছুকে ইসলামের দাওয়াতে ব্যবহার করা সময়ের দাবি। মহানবী (সঃ) এর জমানায় বর্তমান সময়ের মতো প্রেস ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার প্রচলন থাকলে আল্লাহর নবী (সঃ) দীনের প্রচারে মিডিয়াকেই হয়তো উত্তম উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করতেন। কেননা  জনৈক ইসলামী চিন্তাবীদ বলেছেন - তখন যত প্রকার প্রচার পদ্ধতি ছিল তার মধ্যে সর্বোচ্ছ প্রচার পদ্ধতি ছিল কোন বিষয়ে মানুষকে সতর্ক করতে হলে পাহাড়ে উঠে দাওয়াত দেওয়া আর রাসূল (সাঃ) সাফা পাহাড়ে উঠে সে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। সুতরাং আমি বলতে চাই দীনের কাজেও দেশ গঠনে মিডিয়ার ব্যবহার ইবাদত ও জিহাদের অন্তর্ভূক্তি। যার সঙ্গে যুক্ত আমাদের সাংবাদিকরা। সাংবাদিকতা একটি মহান পেশা, দেশ ও সমাজের উন্নয়ন ও বিকাশ সাধন, কুসংস্কার দূর এবং সমাজ দেহ হতে নানা সমস্যা দূর করতে সাংবাদিকতা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। সংবাদ এবং সংবাদপত্র, সাংবাদিক অত্যন্ত নিবিড় বন্ধনে আবদ্ধ এবং একটি ছাড়া আরেকটি অসম্পূর্ণ। এই পেশায় সাফল্য অর্জন করতে হলে মেধার পাশাপাশি সততা, আন্তরিকতা ও নিষ্টার প্রয়োজন সর্বাধিক। সত্যবাদিতা ঈমানের প্রধান শর্ত যেখানে সত্যবাদিতা নেই সেখানে ঈমান নেই। তাই আমি বলতে চাচ্ছি সাংবাদিক ভাইদের অবশ্যই সর্বদা সততা অবলম্বন করতে হবে। কেননা আল্লাহ পাক মহাগ্রন্থ আল কোরআনে বলেছেন তোমরা মিথ্যার সঙ্গে সত্যের মিশ্রণ করোনা এবং জ্ঞানত তোমরা সত্য গোপন করোনসা। সক্রেটিস সম্পর্কে আমরা সবাই জানি, তৎকালীন জালিম শাসকের বিরুদ্ধে কথা বলায় তাকে বিষ খাইয়ে কিংবা ফাঁসি দিয়ে মেরে ফেলার হুমকি দেয়া হল, তখন তার এক ঘনিষ্ঠজন বলল, আপনাকে বাদশাহ মেরে ফেলবে আপনি দেশ ছেড়ে চলে যান। তখন সেক্রটিস দৃপ্তকণ্ঠে বলল ওটাতো ভীরুতার কাজ প্রয়োজনে মৃত্যুবরণ করবো তবুও মিথ্যার আশ্রয় নেবোনা , এবং শেষ পর্যন্ত সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য সক্রেটিস বিষপান করেছিলেন। আমাদের সাংবাদিক ভাইয়েরা যদি সত্যের আশ্রয় গ্রহণ না করে তাহলে আমাদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার, সাংবাদিকদের প্রধান দায়িত্ব হচ্ছে যে কোন ঘটনার সঠিক ও বস্তুনিষ্ঠ চিত্র তুলে ধরা। ভুল কিংবা মনগড়া সংবাদ পরিবেশন না করা কিংবা কাউকে অহেতুক সমালোচনা করা পেশাগত নৈতিকতার পরিপন্থি। প্রত্যেক সাংবাদিকদেরকে খেয়াল রাখতে হবে পান্ডিত্য দেখানো তাদের মুখ্য উদ্দেশ্য নয় তাদের মৌলিক উদ্দেশ্য হল মানবতা ও সৃষ্টির সেবা করা, মনে রাখতে হবে সাংবাদিকগণ জাতির বিবেক, একজন সাংবাদিকের লেখনীর সামনে কখনো অন্যায় প্রতিষ্ঠিত হতে পারেনা। অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য যে, দেশে এক শ্রেণীর সাংবাদিক বিশেষ মহলের নেক নজরের আশায় অনেক সময় পত্র-পত্রিকায় ভুল তথ্য দিচ্ছেন বা বিশেষ মহলের পক্ষে অন্যায়ভাবে সাফাই গাইছেন। অথচ এর প্রভাব পড়ছে সাধারণ জনগণের উপর। অথচ সাংবাদিক ও কলামিষ্টদের সকল ক্ষেত্রে দায়িত্ব নিরপেক্ষ হতে হবে। আদর্শচ্যুত সাংবাদিক জাতিকে বিভ্রান্ত করে। আরেকটি দুঃখজনক দিক হলো রাসূলের যুগে মিডিয়াকে যথাযথ ব্যবহার করা হলেও বর্তমানে মিডিয়াকে ইসলামের দাওয়াতে ব্যবহার করা হচ্ছে না। প্রেস মিডিয়ার ইসলামী সভ্যতার কিছুটা প্রভাব থাকলেও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় নেই বললেই চলে, অথচ ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া বর্তমান যুগের অন্যতম একটি শক্তিশালি মাধ্যম। অথচ টিভির মাধ্যমে নিউজ মিনিটের মধ্যেই দর্শককে জানিয়ে দেয়া হয়। দৈনিক পত্রিকায় একটি কলামের মাধ্যমে হাজারো লোককে আকৃষ্ট করা হয়। যেটা ব্যক্তিগত উদ্যোগ কখনো সম্ভব নয়। ব্যাপারটি যদি এমন  হতো যে, ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার কিছু সদস্য থাকবেন যারা দ্বীনের কথা বলবেন, ইসলামকে সুন্দর উপস্থাপনায় যুক্তি ও তথ্যবহুল আলোচনার মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলবেন তাহলে ওই নির্দিষ্ট সময়টুকু ইসলামের কাজে ব্যবহার হতো। তবে বর্তমানে আলহামদুলিল্লাহ ইসলামিক টিভি ইসলামের দাওয়াতের ক্ষেত্রে ব্যাপক ভূমিকা পালন করছে যা বাংলাদেশে আরো অনেক আগে হওয়া উচিৎ ছিল। কিন্তু এ কথা দিবালোকের মতো সত্য যে বামপন্থীরা যে রকম প্রভাব বিস্তার করছে তাদের তুলনায় আমরা অনেক অনেক পিছিয়ে। টিভিতে অশ্লীলতা আর বেহায়াপনা ছাড়া আর কিছু নেই এই ফতোয়া দিয়ে যদি আমরা পিছে চলে আসি তাহলে দেখা যাবে কিছুদিন পর এই বাংলাদেশে নিজেকে মুসলমান হিসেবে পরিচয় দেওয়াটা কষ্টকর হবে। কাবা চত্বরে মহানবী (সঃ) কিছু সময় দ্বীনের  প্রচার করতেন কিন্তু সেখানে কাফেররা তারচেয়ে অনেকগুণ বেশি মূর্তির গুণগান প্রচার করতো। রাসূল (সঃ) মূর্তি পূজার দুর্গন্ধের কারণে কাবা চত্বরকে উপেক্ষা করে যাওয়াতে ইসলামের সুমহান কাজ থেকে নিবৃত্ত হননি। নির্দিষ্ট একটা  সময় পর্যন্ত এভাবেই কাজ চলছে এক সময় কাবা চত্বর মূর্তি মুক্ত হলো। আর যদি মহানবী (সঃ) মূর্তি দেখে কাবা চত্বর ফেলে চলে আসতেন তাহলে কি হতো? সুতরাং আজকে যদি ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় কোরআন হাদীসে পারদর্শী কিছু যোগ্য আলেম থাকতেন তারা তো অন্তত এটুকু করতে পারতেন যে, ইসলামে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের ব্যাপারে টিভির পর্দায় মানুষদের সামনে তুলে ধরে দিতে। তাহলে মানুষ বিভ্রান্তি থেকে পরিত্রাণ পেতো, মিডিয়ার নিজস্ব কোন শক্তি নেই ইসলামের ক্ষতি করার। কারণ তা একটি যন্ত্র মাত্র। মিডিয়াকে যারা চালায় আমরা যদি তাদের চালাতে পারি বা মিডিয়া জগতে যারা বিচরণ করে আমরাও যদি তাদের পাশে বিচরণ করি তাহলে নিঃসন্ধেহে আমাদের টিভি চ্যানেল সমূহ ইসলামাইজ হয়ে যাবে। আমি চ্যালেঞ্জ করে বলতে পারি তখন বিটিভ, এনটিভি, এটিভি, এটিএন বাংলা, আরটিভি,চ্যাণেল ওয়ানসহ সব টিভি চ্যানেল হয়ে যাবে মরদ মোজাহিদ। তাই আমি পরিশেষে বলতে চাই বর্তমান যুগ মিডিয়ার যুগ সে জন্য ইসলামের দাওয়াতের ক্ষেত্রে একে কাজে লাগানো বর্তমান সময়ের  অপরিহার্য দাবি। ইন্টারনেট, ওয়েবসাইট, ই-মেইল প্রিন্টমিডিয়া ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া প্রভৃতির সাহায্য ইসলামের সৌন্দর্য ও সৌরভকে পৌঁছে দিতে হবে বিশ্বের আনাচে-কানাচে। দাওয়াতের কর্মকৌশল নির্ধারণ হয়ে পরিবেশ পরিস্থিতি বিবেচনা করে, ইসলাম চির সত্য ও চির সুবজ একটি ধর্ম। তাই এই যুগের প্রেক্ষাপটে বাস্তবতার নিরিখে ইসলামের প্রচার-প্রসারের মাত্রা নিরুপণ করা একান্ত প্রয়োজন। ইসলামি ভাব ধারার টিভি চ্যানেল গড়ে তোলা এখন সময়ের দাবী। আদর্শ ও নৈতিকতার মাধ্যমে সমাজে পরিবর্তন আনতে হবে ইলেক্ট্রনিক মিডিয়াকে অবশ্যই কাজে লাগাতে হবে। ইহুদী খ্রীষ্টানরা ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার মাধ্যমে যে হারে তাদের অসভ্য সংস্কৃতি ও সভ্যতাকে বিশ্বের দরবারে পৌছে দিয়েছে, তারা আকাশ সংস্কৃতির মাধ্যমে সমাজকে দেশকে যেভাবে গ্রাস করেছে তার মোকাবিলার জন্য প্রয়োজন ধর্ম ও নৈতিকতার অনুকূলে টেলিভিশন অনুষ্ঠান নির্মাণ করা। যেখান থেকে সুষ্ঠু বিনোদন নৈতিক শিক্ষা ও চারিত্রিক মূল্যবোধ উদ্বুদ্ধ করা হবে। এক কথায় ইলেক্টনিক্য্র মিডিয়াকে সঠিকভাবে কাজে লাগিয়ে ইসলামের অনুপম আদর্শ তুলে ধরতে হবে বিশ্বের দরবারে। তাহলেই দাওয়াত ও তাবলীগের কাজে যথাযথভাবে পালন হবে। -

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন