রবিবার, ৭ এপ্রিল, ২০১৩

পাকিস্তানে যাওয়ার সহজ উপায়... শ ফি ক রে হ মা ন

স্থান  : সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর খাস কামরা। একটা টিভিতে দিগন্ত টেলিভিশনের লাইভ অনুষ্ঠান
চলছে।
কাল : ৬ মার্চ ২০১৩-র দুপুরবেলা।
চরিত্র : বঙ্গবন্ধু কোট পরিহিত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের মাঝারি সারির জনৈক নেতা।
সতর্কীকরণ : সকল ঘটনা, চরিত্র ও সংবাদ সম্পূর্ণ কাল্পনিক।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী (বিরস মুখে নিরস স্বরে) : আসুন। (চেয়ার দেখিয়ে) বসুন। সচিবালয়ে ঢুকতে কোনো অসুবিধা হয়নি তো? গেইটে বলা ছিল।
আওয়ামী নেতা (হাতের ব্যাগটা কার্পেটে রেখে চেয়ারে বসে) : না। সচিবালয়ে ঢুকতে কোনো অসুবিধা হয়নি। তবে সচিবালয় পর্যন্ত আসতে খুব অসুবিধা হয়েছে। আজ ঢাকায় শাপলা চত্বরে আল্লামা শফীর মহাসমাবেশে সারা বাংলাদেশে থেকে হাজার হাজার প্রতিবাদী মানুষ আসছে। ট্রেন, লঞ্চ, কোচ বন্ধ করে দেওয়া সত্ত্বেও হবিগঞ্জ, সিলেট, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা থেকে মানুষ হেটেই আসছে। অনেকে তো দু’একদিন আগেই এসে ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় ছিল। তারাও আজ বিভিন্ন এলাকায় একত্র হয়ে দলে দলে শাপলা চত্বরের দিকে যাচ্ছে। আমি আমার বঙ্গবন্ধু কোটটা ব্যাগে (ব্যাগটা দেখিয়ে) রেখে এখানে এসেছি। একটু পানি খাওয়াবেন?
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী (ইন্টারকমে তার পিএ-কে রুমে এক গ্লাস পানি দিতে বলে বিরক্ত মুখে) : এমন দিনেই আপনি এলেন! আমরা তো আজ সবাই হেফাজতে ইসলামের মহাসমাবেশ নিয়ে মহাব্যস্ত। কখন যে কি হয়ে যায়, কে বলতে পারে? একটা পুলিশের একটা গুলিতে একটা হুজুর নিহত! ব্যস, তারপর সারা দেশে লংকা কাণ্ড বেধে যাবে। তারপর হয়তো ওরা চলে আসতে বাধ্য হবে। আর তখন আমরা কোথায় যাবো? (হঠাত্ চেয়ার থেকে উঠে দাড়িয়ে) একটু টয়লেটে যেতে হবে। আপনি বসুন। টিভিটা দেখুন।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী (মিনিট পাচেক পরে টয়লেট থেকে ফিরে এসে) : আজ না আসলেই পারতেন। আমার শরীর ভালো না। শুনেছি প্রধানমন্ত্রীরও ডায়ারিয়া হয়েছে। তারও শরীর ভালো নেই। আর দেশের অবস্থা যে ভালো নেই তা তো টিভি দেখেই বুঝতে পারছেন। সব হুজুররা দেশ দখল করে ফেলেছে। শাহবাগিদের পেছনে আমরা এত শ্রম ও সাহায্য দিলাম। আওয়ামী টিভি আর দৈনিক পত্রিকাগুলো তাদের দিন রাত চব্বিশ ঘণ্টা দুই মাস জুড়ে এত সাপোর্ট দিল, এমনকি বিরিয়ানির প্যাকেট, মিনারাল ওয়াটার, ক্যাশ টাকা দিল, তাতে কি লাভ হলো? আজ তারা কোথায়? প্রেস ক্লাবের সামনে মানববন্ধনে মাত্র শ’খানেক এসেছিল। তা-ও তারা এসেছিল সকাল দশটার পরে আমাদেরই চাপে। তারপর পালিয়ে গেছে। মত্স্য ভবনের সামনে এসেছিল জনা পঞ্চাশেক। ওরা চলে গেছে। শাহবাগের সামনে এখনো আছে সত্তর জন। এই তো! এই তো মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বলীয়ান প্রজন্মের বাহাদুরি। (আত্মগতভাবে) কাদের সিদ্দিকী আমার নামে বলেন, আমার বহু কলিগ মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিলেও, আমি মুক্তিযুদ্ধে যাইনি। তার ভাষায় আমি রাজাকার। তার কথায় ত্যক্ত বিরক্ত হয়ে আমি শাহবাগে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধে সর্বাত্মক সহযোগিতা করেছিলাম। কিন্তু কি লাভ হলো?
আওয়ামী নেতা (সহানুভূতির স্বরে) : স্যার খুব হতাশ হয়ে পড়েছেন মনে হচ্ছে! দিগন্ত টেলিভিশন দেখছেন কেন? ওটা দেখে তো ডিপ্রেশন আরো বাড়বে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী : একমাত্র ওরাই তো এখন কনটিনিউয়াসলি সরাসরি সম্প্রচার করছে। আর কোনো টিভি স্টেশন তো শাপলা চত্বর থেকে কনটিনিউয়াস লাইভ টেলিকাস্ট করছে না। আমাকে তো প্রতি মুহূর্তে জানতে হবে হুজুররা কি বলছে। শাপলা চত্বরে কি হচ্ছে। এই পদে আমার আগে ছিলেন সাহারা খাতুন। তিনি সেদিন স্বীকার করেছেন বিডিআর বিদ্রোহের খবর প্রথমে তিনি পান মিডিয়ার কাছ থেকে। কোনো সরকারি সংস্থা থেকে নয়। তিনি খুব সাকসেসফুল হোম মিনিস্টার ছিলেন। তাই আমি তাকেই ফলো করছি। তবে হ্যা, এটা ঠিক যে আমাকে এখন শুধু দিগন্ত টেলিভিশনের ওপরই নির্ভর করতে হচ্ছে। যদি দিগন্ত টেলিভিশন নিষিদ্ধ করে দিতাম তাহলে তো জানতাম না আমার পুলিশরা কেমন আচরণ করছে। একটু আগেই শুনলাম এক জায়গায় কিছু পুলিশ হাত নেড়ে হুজুরদের শুভেচ্ছা জানিয়েছে। বুঝতে পারছি না গোপালীরা বিট্রে করছে কিনা। এখন তো দিগন্ত টেলিভিশন নিষিদ্ধ করা অসম্ভব। যেমন অসম্ভব দৈনিক আমার দেশ নিষিদ্ধ করা। যদিও আমার ওপর প্রচণ্ড চাপ আছে পত্রিকাটি নিষিদ্ধ করার। কিন্তু ওটাও আর এখন নিষিদ্ধ করা যাবে না, ইটস টু লেট। খুব দেরি হয়ে গিয়েছে।
আওয়ামী নেতা : কি হবে নিষিদ্ধ করলে?
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী : ওই যে টিভিতে যেসব হুজুরদের দেখছেন, তারা সবাই আমার দেশ-এর পাঠক। ওই পত্রিকাটি পড়েই তারা এখানে এসেছেন। লক্ষ্য করুন কয়েকজন হুজুরের হাতে আমার দেশ। মনে রাখতে হবে, এদের বাইরে আছে আমার দেশ ও নয়া দিগন্তের কয়েক লক্ষ পাঠক। ওরা সবাই দেশে যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করবে তা আমরা কনট্রোল করতে পারবো না। আজকের মহাসমাবেশ দেখুন। কোচ, লঞ্চ, ট্রেন বন্ধ করে দিলাম। ঘাদানিক, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম এবং বামপন্থী বিশ-বাইশটা দলকে দিয়ে হরতাল-অবরোধ ডাকিয়ে দিলাম। তারপরও হাজার হাজার মানুষ।
আওয়ামী নেতা : বেয়াদবি মাফ করবেন স্যার। হাজার হাজার নয়, লাখ লাখ মানুষ। আজ সকালে হেফাজতে ইসলামের জনৈক সংগঠককে প্রশ্ন করা হয়, তিনি কতো মানুষ এই সমাবেশে উপস্থিত হবে বলে আশা করছেন। তখন তিনি উত্তর দেন, “যদি সরকার আয়োজিত হরতাল-অবরোধ না হতো, তাহলে ঢাকায় আজকের জনসমাবেশে এক থেকে দেড় কোটি মানুষ হতো। যানবাহন চলাচলে নিষেধাজ্ঞা আরোপ ও বাধা সৃষ্টির ফলে, আজ হয়তো পঞ্চাশ লক্ষ মানুষ এখানে হবে।” মনে হচ্ছে তার কথাই সঠিক। শাহবাগে জাগরণের প্রথম সপ্তাহে সেখানে মানুষের ভিড় দেখে কেউ কেউ সেটাকে কায়রো বিপ্লবে তাহরির স্কোয়ারের সমাবেশের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। কিন্তু আজকের তুলনায় সেটা কিছুই নয়। এছাড়া মনে রাখতে হবে, শাহবাগের ওই ভিড়ে যুক্ত ছিল বাংলা একাডেমিতে গমনেচ্ছু বই ক্রেতারা এবং মিডিয়ার রিপোর্টার ও ফটোগ্রাফাররা, সুশীল সমাজের লোকরা, আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ, সকল বামপন্থী দল, ড. কামাল হোসেনের গণফোরাম এবং ড. বি চৌধুরীর বিকল্পধারা প্রভৃতির নেতা-কর্মীরা। সবচেয়ে বড় কথা, কিছু তরুণীও সেখানে ছিল। এখন দেখুন, আজকের এই সমাবেশে শুধু ইসলামবিশ্বাসীরাই আছেন। কোনো রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের ভিড় এখন পর্যন্ত হয়নি। যদিও আসার পথে শুনলাম জাতীয় পার্টির কাজী জাফর আহমদ কিছু লোক নিয়ে মিছিল করে আসছেন। তার ক্লিয়ারেন্স পেলে তার নেতা এরশাদও আসতে পারেন। তবে শাহবাগিদের ওখানে প্রথম প্রহরেই ওদের হাইজ্যাক করে আওয়ামী লীগ যে বিরাট ভুল করেছিল এবং যে ভুলের খেসারত এখন তাদের আরো বিরাটভাবে দিতে হচ্ছে — ঠিক সেই রকম ভুলই হয়তো এরশাদ করবেন। এখানে সবাই জানেন, সম্প্রতি দিল্লি থেকে ফিরে এসে তিনি এয়ারপোর্ট থেকে সরাসরি শাহবাগে যেতে চেয়েছিলেন। কাজী জাফরের উপদেশে তিনি সেদিন সেখানে যান নি। এরশাদ বেঁচে গিয়েছেন এবং এখন শাহবাগ কলংকিত না হয়ে শাপলা চত্বরকে স্বাগত জানাতে পারছেন। অন্যদিকে বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া ব্যক্তিগতভাবে শাহবাগিদের সঠিক মূল্যায়ন করেছিলেন। সিঙ্গাপুরে দাতের চিকিত্সার পর ফিরে এসে সেই রাতেই তিনি তার গুলশান অফিসে বিএনপি নেতাদের ডাকেন এবং তারপর শাহবাগিদের বিরুদ্ধে কড়া অবস্থান নেন। তাই আজ শাপলা চত্বরে তিনি তার দুই প্রতিনিধি ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন ও সাদেক হোসেন খোকাকে তার পক্ষ থেকে হেফাজতে ইসলামের প্রতি সমর্থন জানান।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী (আক্ষেপের স্বরে) : আমাদের নেত্রী তো কারো কথা শোনেন না। তিনি সবসময় বলেন, “আমি তো বঙ্গবন্ধুর কন্যা।” তাই তাকে কোনো উপদেশ দেওয়ার সাহস কারো হয় না। কারো উপদেশ না নিয়েই প্রধানমন্ত্রী প্রথমেই বলে বসেন, তার মন কাদে শাহবাগে ছুটে যাবার জন্য। তিনি সেখানে যান নি বটে; কিন্তু ব্লগার রাজীবের মৃত্যুর পর প্রধানমন্ত্রী ছুটে গিয়েছিলেন তার বাড়িতে। সহানুভূতি ও সমর্থন প্রকাশ করেছিলেন শাহবাগিদের প্রতি। দলের নেতা তোফায়েল আহমেদ বলেন, দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধের প্রথম শহীদ হয়েছেন রাজীব।
আওয়ামী নেতা : একটা কথা জিজ্ঞাসা করবো স্যার। প্রথম মুক্তিযুদ্ধটা তো ছিল পাকিস্তানের হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে। কিন্তু দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধটা কার বিরুদ্ধে?
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী : অনেকেই এখন মনে করছেন আমরা মুখে যা-ই বলি না কেন, আসলে দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধটা ইসলামের বিরুদ্ধে। আর সেজন্যই শাহবাগিদেরই শুধু নয়, আওয়ামী লীগকেও ছেড়ে গিয়েছেন অনেকে। তার ফলে আজকে ৬ এপৃলের এই ফাইনাল ম্যাচে হেফাজতে ইসলামের পক্ষে দেখা যাচ্ছে লাখ লাখ মানুষ। শাহবাগিদের পক্ষে এই মুহূর্তে সারা দেশে এক হাজার মানুষও নেই। মনে হচ্ছে, আজ থেকে তৃতীয় মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে গিয়েছে। (চিন্তিত স্বরে) এই তৃতীয় মুক্তিযুদ্ধটা শুরু হয়েছে আওয়ামী লীগের বিপক্ষে। শাপলা চত্বরের বক্তারা আওয়ামী লীগকে চিহ্নিত করছেন ইসলামবিরোধী, স্বাধীনতাবিরোধী এবং গণতন্ত্রবিরোধী রূপে। একাত্তরের নয় মাসের চেতনা হারিয়ে যাচ্ছে প্রায় চৌদ্দশ বছর আগের ইসলামী চেতনার কাছে।
আওয়ামী নেতা : ইসলামী চেতনা মুক্তিযুদ্ধ চেতনার বিরোধী নয়। কখনোই তা ছিল না। শাহবাগে একটা ভুল ধারণার জন্ম আমরাই দিয়েছি আমাদের রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জনের জন্য। আমরা চেয়েছিলাম বিডিআর বিদ্রোহ, শেয়ারবাজার কেলেংকারি, কুইক রেন্টাল কেলেংকারি, হলমার্ক কেলেংকারি, ডেসটিনি কেলেংকারি, পদ্মা সেতু কেলেংকারি, সবকিছু ধামাচাপা দিয়ে মুক্তিযুদ্ধকে পুজি করে পরবর্তী নির্বাচনে জিততে। বিএনপি-জামায়াতের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবির আন্দোলন থেকে ভোটারদের দৃষ্টি অন্যদিকে সরাতে। কিন্তু আমরা বোধহয় সেটা পারলাম না। (টিভির দিকে তাকিয়ে) আমরা আজ এখানে দেখছি পুরুষদের সমাবেশ। কোনো নারী এখানে নেই। শুধু পুরুষরাই এতো! এদের পেছনে আছে লক্ষ লক্ষ নারী—যারা এদের চাইতেও বেশ ধর্মপরায়ণ। আর কে না জানে, সাধারণ নারীদের অধিকাংশই পছন্দ করে বিএনপি নেত্রীকে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী : হ্যা। তাই তো! নারীদের ছাড়াই পুরুষদের এতো বড় সম্মেলন। ভোটকেন্দ্রে যখন এই পুরুষদের পাশে দাড়াবে নারীরা তখন কি হবে?
আওয়ামী নেতা : শেখ হাসিনা হয়তো এবার নির্বাচনে গোপালগঞ্জেই হারবেন। অন্যখানে পরাজিত হবার অভিজ্ঞতা তার আছে। কিন্তু তার হোম কনস্টিটুয়েন্সিতে পরাজিত হবার অভিজ্ঞতা হয়তো এই প্রথম হবে। যদি অবশ্য তিনি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন বা করার সুযোগ পান।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী : সে কথায় আমরা পরে আসবো। এখন বলুন আজকের সমাবেশে আপনি আর কি লক্ষ্য করছেন।
আওয়ামী নেতা : এক. এখানে ফেস্টুন, প্ল্যাকার্ড ও ব্যানারের সংখ্যা খুবই কম; বাংলাদেশের পতাকা আছে। কিন্তু তার সংখ্যাও কম। দুই. কোনো নেতা, নেত্রী অথবা কোনো পরিবারের ছবিসহ একটাও পোস্টার নেই। তিন. আওয়ামী লীগের জনসমাবেশের মতো কারো হাতে লাঠি-বৈঠা-লগি নেই। কারো পকেটে পিস্তল আছে বলে মনে হচ্ছে না। চার. কোনো দলীয় প্রতীক নেই। ধানের শীষ, নৌকা, লাঙ্গল, দাড়িপাল্লা নেই। পাচ. শাহবাগিদের মতো মঞ্চ থেকে কারো লম্বা বোরিং স্লোগান মার্কা বক্তৃতা নেই। এখন পর্যন্ত সব বক্তাই এক মিনিটের মধ্যে তাদের বক্তব্য শেষ করেছেন। ছয়. কারো পরনে জিন্স ও টি-শার্ট নেই। সাত. অধিকাংশ মানুষই তরুণ। তাদের পরনে পায়জামা ও লম্বা পাঞ্জাবি যার রং শাদা। অনেকের মাথায় শাদা টুপি। কারো মাথায় ছোট পাগড়ি। অনেকের দাড়ি আছে। অনেকের নেই। আট. নির্ধারিত সময়ের মাত্র পাচ মিনিট পরে, সকাল দশটা পাচে সমাবেশের কাজ শুরু হয়েছে। এই সময়ানুবর্তিতা প্রশংসনীয়। এ থেকে হেফাজতে ইসলামের অর্গানাইজিং পাওয়ারের পরিচয় পাওয়া গেছে। নয়. মঞ্চে প্রথমে শুধু দিগন্ত টিভির মাইক্রোফোন দেখা গেছে। শাহবাগে অনেক সময় বক্তাদের চাইতে টিভি রিপোর্টার, ক্যামেরামেন ও মাইক্রোফোনের সংখ্যা বেশি ছিল। দশ. শাপলা মঞ্চ থেকে জনতাকে পরিবেশসচেতন থাকতে অনুরোধ করা হয়েছে। পানির প্লাস্টিক বোতল পথে না ফেলতে বলা হয়েছে। শাহবাগে পরিবেশশত্রুতা দেখা গেছে। এগার, আল্লামা শফী লংমার্চকারীদের শুধু তিনটা জিনিস আনতে বলেছিলেন—জায়নামাজ, তসবিহ এবং মেসওয়াক বা টুথব্রাশ। এই ধরনের কোনো নির্দেশ শাহবাগে ছিল না। বারো. শাহবাগে পথনাটক ও গানবাজনা ছিল। শাপলা চত্বরে অনুষ্ঠানের সূচনায় একটি নতুন গান ছিল—যার কয়েকটি লাইন ছিল কাজী নজরুলের। তের. শাহবাগে বিরিয়ানি ও পানি সাপ্লাই করেছিল আওয়ামী সমর্থক মিডিয়া ও আওয়ামী বিজনেসম্যানরা। শাপলা চত্বরে এবং সেখানে যাবার পথে পথে সব রকম খাবার, ফল ও শরবত স্বতঃস্ফূর্তভাবে সাপ্লাই করেছে স্থানীয় মানুষ।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী : আরো কিছু বলবেন?
আওয়ামী নেতা : বক্তাদের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য মন্তব্যের মধ্যে ছিল—এক. এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম ইসলাম প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম। দুই. প্রধানমন্ত্রী মুখে গণতন্ত্রের বুলি, চাপার মধ্যে আটক। তিন. আর কোনোদিনই কোনো মসজিদে তালা দেয়া যাবে না। ঢাকা ছিল মসজিদ নগরী। চার. এই সরকার ইসলামবিরোধী সরকার, এই সরকার গণতন্ত্রবিরোধী সরকার। পাচ. যেখানেই লংমার্চের বিরুদ্ধে অবরোধ, সেখানেই প্রতিরোধ। লাগাতার হরতাল। ছয়. দাবি না মানলে সরকারকে এখনই বিদায় নিতে হবে। সাত. বাংলাদেশের স্বাধীনতা সূর্য উদিত হয়েছিল চট্টগ্রাম থেকে। নাস্তিকদের কবর রচিত হবে চট্টগ্রাম থেকে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী (হঠাত্ উঠে পড়ে) : আমাকে আবার টয়লেটে যেতে হবে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী (পাচ মিনিট পরে টয়লেট থেকে ফিরে এসে) : সরকার কিভাবে বিদায় নেবে? সেটা কি সম্ভব?
আওয়ামী নেতা : সম্ভব। পাচ ফেব্রুয়ারি থেকে ছয় মার্চ। মাত্র একষট্টি দিন। এর মধ্যে আমাদের সরকার, আমাদের পার্টি ধরা খেয়ে গিয়েছে। আমরা কি ফেব্রুয়ারিতে ভেবেছিলাম আজ এই দশা হবে? আমাদের বিদায় নিতে হবে?
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী : সেটা ঘটতে পারে?
আওয়ামী নেতা : শাপলা চত্বরীরা বলছে তাদের তের দফা দাবি সরকারকে মানতে হবে। তাদের দাবির মধ্যে রয়েছে—ইসলামের বিরুদ্ধে যারা কটূক্তি করেছে, মহানবীর বিরুদ্ধে যারা কুত্সা রটনা করেছে, তাদের বিচার করতে হবে এবং সেজন্য আইন সংশোধন করে তাদের সর্বোচ্চ শাস্তি দিতে হবে। সংবিধানে আল্লাহর প্রতি আস্থা প্রকাশ করতে হবে। তারা সবশেষে আবারো বলেছে, এই সরকার ইসলামের শত্রু। এই সরকারকে বিদায় নিতে হবে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী : মনে হচ্ছে বাংলাদেশে দ্বিতীয় আয়াতুল্লাহ খোমেনির আবির্ভাব ঘটেছে, যিনি ইসলাম রক্ষা করতে চান কিন্তু ক্ষমতা চান না।
আওয়ামী নেতা : হ্যা। আজকের একটা স্লোগান ছিল— “সব ধর্ম বাচাও, দেশ বাচাও।” আমাদের নেত্রী হাসিনা ইসলামী লেবাসে হাতে তসবিহ রেখে পোস্টার ছাপেন। তিনি প্রায়ই বলেন, তিনি একজন মুসলমান এবং পাচ ওয়াক্ত নামাজ পড়েন। কিন্তু তার কথা মুসলিমরা আর কেউ বিশ্বাস করছেন না। শেখ হাসিনা অনেক ভুল করেছেন। এক. তিনি ভুলে গিয়েছেন এই ভূখণ্ডের শোষিত বঞ্চিত অনগ্রসর মুসলিমদের জন্য পাকিস্তান নামে একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার অন্যতম নেতা ছিলেন তারই পিতা। দুই. স্বাধীন বাংলাদেশ যে মানচিত্র পেয়েছে সেটা উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া। এই মানচিত্র ছিল পূর্ব পাকিস্তানের মানচিত্র। আর যেহেতু এই দেশের শতকরা পচাশি থেকে শতকরা নব্বই জনই মুসলিম, সেহেতু সেই মানচিত্রে প্রতিফলিত হবে প্রধানত মুসলিমদের আশা-আকাঙ্ক্ষা। তিন. কিন্তু তার মানে এই নয় যে, সংখ্যালঘুরা বিপদে থাকবে। বস্তুত এই দেশের মুসলিমরা সবসময়ই অন্য ধর্মাবলম্বীদের প্রতি শ্রদ্ধা দেখিয়ে শান্তিপূর্ণসহ অবস্থানের পরিবেশ বজায় রেখেছে। শেখ হাসিনা ভুল করে হিন্দু-মুসলিম বিভাজন চেয়েছেন। চার. এই দেশের মুসলিমরা এখন প্রতিবাদ করছে কারণ, যারা নাস্তিক অথবা ইসলামবিরোধী তারা নিজেদের গণ্ডির বাইরে গিয়ে ইসলামবিশ্বাসীদের চরম অপমান ও অশ্লীল আক্রমণ করেছে। সমস্যাটা হয়ে গেছে সেখানেই। শেখ হাসিনা এটা বুঝতে পারেননি। তাই তিনি প্রকাশ্যে নাস্তিকদের সমর্থন জানিয়েছেন এবং সংসদের ভাষণে বিচার বিভাগকে অনুরোধ করেছেন তারা যেন নাস্তিকদের অনুভূতির প্রতি সদয় বিবেচনা করে রায় দেন। শেখ হাসিনা এই লক্ষ্যে সম্প্রতি সিনিয়রিটি ডিঙিয়ে জনৈক বহু বিতর্কিত বিচারপতিকে আপিল বিভাগে প্রমোশন দিয়েছেন। পাচ. শেখ হাসিনা বোঝেন নি যে ইসলামের নামে এদেশে নিয়মিতভাবে মহা জনসমাবেশ হয়। প্রতি বছর তুরাগ নদীর তীরে ইজতেমায় এবং শোলাকিয়ায় ঈদে। এছাড়া প্রতি বছর মুসলিমরা চেষ্টা করেন বিশ্বের সর্ববৃহত্ জনসমাবেশ হজে যেতে। (একটু থেমে) আসলে আমাদের নেত্রী ইসলাম ধর্মে নয় — সুযোগ ধর্মে বিশ্বাস করেন। তাই যখন দরকার তখন জামায়াত নেতাদের সঙ্গে সমঝোতা করেন, আন্দোলন করেন। খেলাফতে মজলিসের সঙ্গে চুক্তি করেন। আবার যখন দরকার তখন তাদের গ্রেফতার করেন। তাদের ফাসি দেওয়ার কারসাজি করেন। ফাসি দিতে আইনও বদলান। এখন তার বহুরূপ সাধারণ মানুষ জেনে গিয়েছে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী : মেনন তো বলেছেন আমাদের আমও গেছে ছালাও গেছে। তা-ই হয়তো হবে। এখন বলুন, আপনি কেন আজই আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন। আমার এতো ব্যস্ততার মধ্যেও আমি দেখা করতে রাজি হয়েছি কারণ আপনি আমার এলাকার একজন নেতা।
আওয়ামী নেতা (ব্যগ্রস্বরে) : আমি পাকিস্তানে যেতে চাই। আমাকে পাকিস্তানে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিন স্যার। পারলে আজই।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী (অবাক চোখে) : পাকিস্তানে?
আওয়ামী নেতা : আজ বিভিন্ন পত্রিকায় আছে অনেক আওয়ামী নেতা এবং আওয়ামীপুষ্ট ব্যবসায়ী শিল্পপতিরা সপরিবারে দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। কেউ আমেরিকা, কেউ ইংল্যান্ড, কেউ দুবাই, কেউ ইনডিয়া, কেউ মালয়শিয়া, কেউ সিঙ্গাপুরে। আমি স্যার গরিব মানুষ। আমি কোথায় যাবো, কিভাবে যাবো, তা বুঝতে পারছিলাম না। ৩১ মার্চ মেহেরপুরে মুজিবনগর থানা ভবন উদ্বোধনের সময়ে সুধী সমাবেশে বিরোধী নেত্রী খালেদা জিয়ার প্রতি ইঙ্গিত করে আপনি বলেন, “গণতান্ত্রিক সরকার, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা পছন্দ না হলে, পাকিস্তানে হিজরত করুন। হিজরতের জন্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসাবে আমি সব ব্যবস্থা করে দেব।”
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী : হ্যা। আমি বলেছিলাম। একাত্তর থেকেই তো আমি পাকিস্তানের গুড বুকে আছি। আমি রিকোয়েস্ট করলে ওরা শুনবে।
আওয়ামী নেতা : সেজন্যই তো স্যার আপনার কাছে এসেছি।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী : ঠিক আছে। আপনার ভিসা যেন তাড়াতাড়ি হয়ে যায় সেই ব্যবস্থা করবো। কিন্তু কতোদিনের ভিসা আপনি চান?
আওয়ামী নেতা : এক বছরের।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী : এক বছর কেন?
আওয়ামী নেতা : আপনার নিশ্চয়ই মনে আছে, ২৭ মার্চ ২০১৩-তে চীন-বাংলা মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রে আমাদের নেত্রী শেখ হাসিনা স্বাধীনতা দিবস আলোচনা সভায় বিরোধী নেত্রীকে উদ্দেশ করে বলেন, “আপনার প্রিয় পাকিস্তানে আপনি চলে যান। দিল মে যো পেয়ার হ্যায়, তা নিয়ে পাকিস্তানে যান।”
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী : হ্যা। উনি বলেছিলেন। ওনার কথাতেই আমি ইনস্পায়ার্ড হয়ে পাকিস্তানে হিজরতের সব ব্যবস্থার অফার তাকে করেছিলাম।
আওয়ামী নেতা : আসলে আমাদের নেত্রীরই
হৃদয়ে পাকিস্তানে প্রেম দৃঢ়ভাবে প্রোথিত। তাই তিনি উর্দুতে এই প্রস্তাব দেন। আমাদের নেত্রীর মধ্যে
এই পাকিস্তান প্রেম প্রীতি পেয়ার মহব্বত উত্তরাধিকার সূত্রে প্রোথিত। একাত্তরে গণআন্দোলনকে
পেছনে ফেলে তার পিতা পাকিস্তানে হিজরত করেছিলেন। এখন ২০১৩-তে তিনি সেই পথই অনুসরণ করবেন।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী (হতভম্ব মুখে) : কেন? পাকিস্তানে কেন?
আওয়ামী নেতা : কারণ শেখ হাসিনা মনে করেন নয়-দশ মাস পাকিস্তানে কাটিয়ে আসতে পারলে তিনি নিজেকে সাচ্চা মুসলমান রূপে আবার প্রতিষ্ঠা করতে পারবেন। তৌহিদি জনতার কাছে আবার গ্রহণযোগ্য হতে পারবেন। শোনা যাচ্ছে বাংলাদেশ থেকে তাকে নিরাপদে অন্য দেশে পাঠিয়ে দেওয়ার আলোচনা এই মাসের প্রথম সপ্তাহে দিল্লিতে শীর্ষ পর্যায়ে দ্বিপাক্ষিকভাবে হয়েছে। সরকারের পতন ঘটলে, হাসিনা ইনডিয়াতে যেতে পারবেন না কারণ পরবর্তী সরকারের সঙ্গে ইনডিয়ান সরকার সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করতে চাইবে। হাসিনা আমেরিকায় যেতে পারবেন না কারণ আমেরিকান সরকারের বিরুদ্ধে তিনি শত্রুতা করেছেন প্রকাশ্যে, এক ড. ইউনূসকে বেইজ্জতি করে এবং দুই সম্প্রতি রাশিয়ার কাছ থেকে সমরাস্ত্র কেনার চুক্তি করে। হাসিনা কানাডাতে যেতে পারবেন না কারণ সেখানে পদ্মা সেতুর যে দুর্নীতি মামলা শুরু হবে ৮ এপৃলে তাতে তিনি জড়িয়ে যেতে পারেন। আমেরিকায় যেতে না পারলে তিনি বৃটেনেও যেতে পারবেন না। কারণ বৃটেন শোনে আমেরিকার কথা। আর আজকের মহাসমাবেশে ইসলামের শত্রু রূপে চিহ্নিত হবার পরে এখন কোনো মুসলিম দেশেও তিনি যেতে পারবেন না। পাকিস্তান হবে ব্যতিক্রম। তারা যেভাবে গত চার বছর অপমানিত হয়েছে, সেটার প্রতিশোধ নেয়ার সুযোগ তারা হাতছাড়া করবে না। এটা জেনেও হাসিনা পাকিস্তানে যাবেন। কারণ পাকিস্তানই তাকে সুযোগ দিতে পারবে আরেকটি দশই জানুয়ারি পালন করবার। আমি ফুল নেতা হয়ে তার সঙ্গেই বাংলাদেশে ফিরে আসবো।
হঠাত্ টেলিফোনটা বেজে উঠলো।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পিএ : স্যার। পাকিস্তানি অ্যামবাসাডরকে আপনি চেয়েছিলেন। উনি লাইনে আছেন। দেব স্যার?
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী : হ্যা, দেন। (পাকিস্তানি রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে কথা শুরু হলো) থ্যাংক ইউ ইয়োর একসেলেন্সি। হ্যা, ভিসা অ্যাপ্লিকেশন আমরা করছি। তবে কিছু কারেকশন আছে। ফার্স্ট. খালেদা জিয়ার জন্য নয়, শেখ হাসিনার জন্য ভিসা দরকার। সেকেন্ড. আমার এক পার্টি ওয়ার্কারের জন্য ভিসা দরকার। আর থার্ড. আমার নিজের জন্যও একটা ভিসা দরকার। ইমিডিয়েট...(দৈনিক আমার দেশ থেকে সংকলিত)


1 টি মন্তব্য: