রবিবার, ১৫ ডিসেম্বর, ২০১৩

পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল ভোটারবিহীন নির্বাচন

ভোটারবিহীন এমপি নির্বাচনের ঘটনা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল বলে মন্তব্য করেছেন দেশের বিশিষ্ট নাগরিকেরা। তারা বলছেন, আওয়ামী লীগ যে নির্বাচন করছে তা অর্থহীন এবং হাস্যকর ও অগ্রহণযোগ্য। এটা ইলেকশন নয়, সিলেকশন। দেশের বর্তমান সঙ্কট থেকে উত্তরণের উপায় ও ভোটারবিহীন নির্বাচন সম্পর্কে খোলামেলা কথা বলেছেন বিশিষ্টজনেরা। তারা বলেন, ভোটার ছাড়াই ভোট এবং ভোটারবিহীন নির্বাচন কেউ আশা করে না। জাতীয়ভাবে এবং আন্তর্জাতিকভাবে এ নির্বাচন গ্রহণযোগ্যতা পাবে না। এতে দিন দিন অশান্তি বাড়বে।
তারা আরো বলেন, বর্তমান সমস্যার সমাধানে দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল ও সুধী সমাজকে বসে চিন্তা করা দরকার। কাউকে বাদ দিয়ে নয়, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হলেই কেবল দেশে গণতন্ত্র শান্তি ও স্থিতিশীলতা ফিরে আসবে। স্বাধীনতার ৪২ বছর পরে এসে বলতে হচ্ছেÑ দেশ সত্যিকারের স্বাধীন হয়নি। অর্থনৈতিকভাবেও স্বাধীন হয়নি। বর্তমান অবস্থায় স্বাধীনতার স্বপ্ন ধূলিসাৎ হতে চলেছে বলে মন্তব্য দেশের বিশিষ্টজনদের।
প্রবীণ আইনবিদ ব্যারিস্টার রফিক-উল হক বলেন, নির্বাচনের আগেই সরকার দুই গোল দিয়ে ফেলেছে। একদলীয় নির্বাচন সবাই দিয়েছে। শেখ সাহেব যেটা দিয়েছিলেন সেটা নির্বাচন ছিল কিন্তু তখন সিলেকশন হয়নি। বর্তমানে যেটা হচ্ছে সেটা সিলেকশন, ইলেকশন নয়। ভোটার ছাড়া ভোট এবং ভোটারবিহীন নির্বাচন। এটা আমরা আশা করি না। এতে দিন দিন অশান্তি বাড়বে।
তিনি বলেন, ডেমোক্র্যাটিক (গণতান্ত্রিক) আচরণ করতে হবে। কিন্তু এখন অটোক্র্যাটিক ডেমোক্র্যাসি বা স্বৈরতান্ত্রিক গণতন্ত্র এসেছে। বর্তমান সমস্যার সমাধানে দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল ও সুধী সমাজকে বসে চিন্তা করা দরকার। কাউকে বাদ দিয়ে হবে না।
প্রবীণ এ আইনবিদ বলেন, ‘এরশাদ সাহেবকে কেন সিএমএইচে পাঠানো হলো? আমি অসুস্থ হলে ডাক্তার নিয়ে যাবে, র‌্যাব কেন নেবে? সুষ্ঠু নির্বাচন হলে দেশে গণতন্ত্র আসবে; তা না হলে গণতন্ত্র ও শান্তি আসবে না। সুষ্ঠু নির্বাচন হলে কেবল পথ বের হতে পারে। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ১৫৬ জন নির্বাচিত হলে বাকি যারা আছে তারাও নির্বাচিত হয়ে যাবেন।’
ব্যারিস্টার রফিক-উল হক বলেন, ‘বর্তমান অবস্থায় সাধারণ মানুষই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। রাজনীতিবিদদের নয়, সাধারণ মানুষেরই জীবন যাচ্ছে। বিরোধী দলের উদ্দেশে তিনি বলেন, আপনি অবরোধ করেন, হরতাল করেন শান্তিপূর্ণভাবে। এ অবস্থায় বিএনপির কিছু করা দরকার। কিন্তু বিএনপি কিছু করছে না। কার বুদ্ধিতে বিএনপি চলছে আমি বুঝতে পারছি না।’
তিনি বলেন, অবরোধে দেশের অর্থনীতি শেষ হয়ে যাবে। অর্থনীতি টিকবে না। স্বাধীনতার ৪২ বছর পরে বলতে হচ্ছে দেশ সত্যিকারের স্বাধীন হয়নি। অর্থনৈতিকভাবেও স্বাধীন হয়নি। কেবল সামাজিক স্বাধীন হলেই চলবে না। বর্তমান অবস্থায় স্বাধীনতার স্বপ্ন ধূলিসাৎ হয়ে যাবে।
বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক ড. এমাজউদ্দীন আহমদ বলেন, বর্তমানে সরকার যেভাবে নির্বাচন করছে তা অর্থহীন। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বিরোধী দলকে বাদ দিয়ে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হতে পারে না। এ জন্য সরকারি দল বেশির ভাগ আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার এই প্রক্রিয়াটা সম্পূর্ণ অর্থহীন।
এই নির্বাচন জাতীয় বা আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য হবে না উল্লেখ করে তিনি বলেন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন অনেক আগেই বলেছে তারা এই নির্বাচনে পর্যবেক্ষক পাঠাবে না। এখন সমঝোতার দিকে এগিয়ে আসতে আর দেখছি না। বিবেককে ব্যবহার করলে এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব। তা না হলে এই নির্বাচন অর্থহীন হবে। বর্তমান অবস্থায় দেশে সঙ্ঘাত বাড়বে আমরা অনিশ্চিত গন্তব্যের দিকে অগ্রসর হবো।
ড. এমাজউদ্দীন আহমদ বলেন, আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করে সুষ্ঠু নির্বাচনের উদ্যোগ নিলেই কেবল দেশে শান্তি ফিরে আসতে পারে। তারানকো যে আলোচনার সূচনা করে গেছেন তার মাধ্যমে সমঝোতা ও সমাধানের উপায় বের করতে হবে।
তিনি আরো বলেন, বর্তমানে নির্বাচন কমিশনের কোনো অথরিটি নেই। প্রধানমন্ত্রী যেভাবে নির্দেশনা দিচ্ছেন সব কিছু সেভাবে হচ্ছে। এখন আলোচনা ছাড়া আর কোনো পথ নেই। সমঝোতা না হলে দেশের ক্ষতি বাড়বে, জীবনের ক্ষতি হবে এবং দেশের সম্পদের ক্ষতি হবে।
একটি স্বপ্নের দেশ হিসেবে আমরা বহু সংগ্রাম ও ত্যাগের বিনিময়ে স্বাধীনতা লাভ করেছি। এখন সচেতনতা ও প্রজ্ঞা দিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে বলে মনে করেন অধ্যাপক এমাজউদ্দীন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. তোফায়েল আহমদের বিশ্লেষণ হলোÑ নির্বাচনের বৈধতা-অবৈধতা, গ্রহণযোগ্যতা-অগ্রহণযোগ্যতা তা আইনগত, শাসনতান্ত্রিক ও সাংবিধানিক দিকের ওপর নির্ভর করে। সাংবিধানিক দিকে দিয়ে তারা নির্বাচন করছেন। কিন্তু রাজনৈতিক ও নৈতিকতার দিক দিয়ে এটার গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। তিনি বলেন, যারা তিন তিনবার সরকারে ছিল। তারাই এই নির্বাচনে অনুপস্থিত। ফলে এই নির্বাচন কারো কাছেই গ্রহণযোগ্য হবে না; আর যা হচ্ছে তা ইতিহাস হয়ে থাকবে। তিনি বলেন, সরকার নিজেকে রক্ষা করছে। আমাদের দেশের নির্বাচনের ইতিহাস ও ঐতিহ্য যেটা ছিল তাকে সরকার ুণœ করেছে। এটা সরকারের আগে থেকে পরিকল্পনা।
তিনি বলেন, ঢাকার বাইরের জেলাগুলোতে আজ যে অবস্থা তাতে সেখানে গিয়ে মহাজোটের প্রার্থীরা নির্বাচন করতে পারবেন না। এমনকি সরকারের মন্ত্রীরাও ঢাকায় বসে আছেন। তাই সরকার নির্বাচনকে মনোনয়নে পরিণত করেছে।
নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. দিলারা চৌধুরী বলেন, আওয়ামী লীগ এমন এক মাসে প্রার্থীবিহীন নির্বাচন করল যে মাস বিজয়ের মাস। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মাস। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এমপি নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধ ও গণতন্ত্রের চেতনা ভূলুণ্ঠিত করেছে। প্রার্থীবিহীন নির্বাচন পৃথিবীর ইতিহাসে অতীতে কখনো ঘটেনি। বিশ্বে এ ধরনের নির্বাচন এবারই প্রথম।
তিনি বলেন, এ নির্বাচন হাস্যকর, অগ্রহণযোগ্য ও প্রহসনের। দেশের জনগণ ও কোনো উন্নয়নকামী মানুষ কেউই মেনে নিবে না। ভোটারবিহীন নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত হয়ে আওয়ামী লীগ যদি সরকার গঠন করে তাহলে বাংলাদেশের মানুষ বাকশালের নতুন রূপ দেখবে বলে মনে করেন ড. দিলারা চৌধুরী।
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. পিয়াস করিম বলেন, বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এমপি নির্বাচনের ঘটনা সবচেয়ে প্রহসনমূলক, যা অতীতে কখনো হয়নি। তিনি বলেন, আমরা এমন এক দিনে এ ধরনের নির্বাচন দেখছি যখন বুদ্ধিজীবী দিবস। এ নির্বাচনের মাধ্যমে বুদ্ধিজীবীরা আরেকবার শাহাদতবরণ করল। যত কিছুই করুক আওয়ামী লীগ পার পাবে না।
বিশিষ্ট দার্শনিক হেগেল ও কার্ল মার্কসের উদ্ধৃতি দিয়ে পিয়াস করিম বলেন, ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটে। অতএব আওয়ামী লীগ যা করছে এরও ফল পেতে হবে। তিনি বলেন, শেখ মুজিবুর রহমান ৭৫ সালে গণতন্ত্র হত্যার ট্রাজেডি ঘটিয়েছিল। এবার পরিহাস হলো।
তিনি আরো বলেন, সরকারের মৃত্যঘণ্টা বেজে গেছে। অত্যাচার নিপীড়নের দিন একদমই শেষ। ঢাকার আকাশে র‌্যাবের হেলিকপ্টার টহল দিয়ে টিকে থাকা যাবে না। যদি এ ধরনের অপকর্ম করে টিকে থাকা যেত তাহলে তার বাবা শেখ মুজিবও রক্ষা পেতেন। কিন্তু তারও শেষ রক্ষা হয়নি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল বলেন, বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এমপি নির্বাচন বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে সবচেয়ে কলঙ্কজনক ঘটনা। শুধু তাই নয় এ নির্বাচন প্রহসনমূলক, অগ্রহণযোগ্য, হাস্যকর ও অগণতান্ত্রিক। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ নিজেদের গণতান্ত্রিক দল বলে দাবি করে। কিন্তু তাদের অধীনে এ ধরনের নির্বাচন কল্পনা করা যায় না। এ নির্বাচনে একটি ভোটারও ভোট দেয়নি। অথচ প্রার্থীরা নির্বাচিত হয়ে গেলেন। পৃথিবীর ইতিহাসে এ ধরনের ঘটনা বিরল।
তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের এ ধরনের কর্মকাণ্ড দেখে মনে হয় গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও ভোটাধিকারের সংজ্ঞা এখন থেকে নতুনভাবে লিখতে হবে।
বাংলাদেশের সামরিক বা স্বৈরশাসকদের আমলে এ ধরনের ঘটনা হয়নি উল্লেখ করে ড. আসিফ নজরুল বলেন, অতীতে নির্বাচন হতো ভোটারবিহীন। কিন্তু এখন নির্বাচন হচ্ছে প্রার্থীবিহীন! তিনি বলেন, যদি কেউ মনে করেন যে, এ ধরনের নির্বাচন করে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে ক্ষমতায় থাকবে। তাহলে ধরে নিতে হবে ভোট সম্পর্কে তাদের ধারণা দুর্বল।nayadiganta

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন