বৃহস্পতিবার, ২৩ জানুয়ারী, ২০১৪

৪৯ সদস্যের মন্ত্রিসভার শপথ ; নবরূপে বাকশাল কায়েম হল ; শেখ হাসিনার তৃতীয়বারের প্রধানমন্ত্রিত্বের খায়েশ পূরণ


ভোটার ও প্রার্থীবিহীন ধিকৃত নির্বাচন, সংবিধান লঙ্ঘন করে নবম সংসদ বহাল রেখেই দশম সংসদের এমপিদের গেজেট ও শপথ কেলেঙ্কারির পর এবার একটি নজিরবিহীন গোঁজামিলের সরকার শপথ নিয়েছে। একই সঙ্গে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা তৃতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী হওয়ার খায়েশও পূরণ করছেন। এর মধ্য দিয়ে বিরোধী দলবিহীন অভিনব একদলীয় শাসনের যাত্রা শুরু হয়েছে। অনেকটা নবরূপে বাকশালী শাসনই কয়েম হয়েছে। ভাগাভাগির নির্বাচনী প্রহসনে জয়ী ঘোষণা 
করা সব রাজনৈতিক দলেরই প্রতিনিধিত্ব আছে নয়া সরকারে। সংসদে যত দল, সরকারেও তত দল। সংসদীয় গণতন্ত্রে অপরিহার্য বিরোধী দল বলে কিছু থাকলো না গতকালের শপথ অনুষ্ঠানের পর। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে শপথ নিয়েছেন নতুন সরকারের ৪৯ জন মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রী। নতুন মন্ত্রিসভায় ২৯ জনকে পূর্ণ মন্ত্রী হিসেবে শপথ পড়িয়েছেন প্রেসিডেন্ট মো. আবদুল হামিদ। শপথ পড়েছেন ১৭ জন প্রতিমন্ত্রী ও দু’জন উপমন্ত্রী। বিকাল সাড়ে তিনটায় বঙ্গভবনে এ শপথ অনুষ্ঠান হয়। মন্ত্রীদের শপথ নেয়ার আগে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তৃতীয়বারের মতো শপথ নেন শেখ হাসিনা।
দেশি-বিদেশি কঠোর সমালোচনা ও চাপ উপেক্ষা করে অদ্ভূত রকমের নতুন সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণের পর শেখ হাসিনা আবারও বেশ দম্ভভরে ঘোষণা করেছেন ‘শেখ হাসিনা কোনো চাপের কাছে মাথানত করে না। জাতীয় বা আন্তর্জাতিক চাপ, যা-ই হোক।’ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফ বলেছেন, ‘আমরা পাঁচ বছরের জন্য ক্ষমতা গ্রহণ করেছি’। যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘মোটামুটি ক্লিন মন্ত্রিসভা হয়েছে’। বহু নাটকের জন্ম দিয়ে সিএমএইচ থেকে গতকাল বঙ্গভবনে শপথ অনুষ্ঠানে যোগদানের পর জাপা চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদ বলেছেন, ‘মন্ত্রিসভা ভালোই হয়েছে’। 
অন্যদিকে গতকাল শপথ নেয়া সরকারকে অবৈধ অভিহিত করে বিএনপি ১২ জানুয়ারিকে কালো দিন হিসেবে ঘোষণা করেছে। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গতকাল এক বিবৃতিতে বলেন, বাংলাদেশের জন্য আজ একটি কালো দিন। অনৈতিক ও অবৈধ সরকারের শপথ গ্রহণের মধ্য দিয়ে গণতন্ত্রের অশুভ যাত্রা শুরু হলো। গণতান্ত্রিক চেনতাকে কবর দিয়ে স্বৈরতান্ত্রিক একনায়কতন্ত্রের কালিমাময় যাত্রা শুরু হলো।
আবার অভিনব সরকারের কঠোর সমালোচনা করেছেন সংবিধান বিশেষজ্ঞ ও বিশিষ্টজনরা। জাতীয় পার্টির একই সঙ্গে মন্ত্রিসভা ও বিরোধী দলে যোগ দেয়া প্রসঙ্গে বিশিষ্ট আইনজীবী রফিক-উল হক বলেছেন, ‘জাতীয় পার্টি বিরোধী দল ও সরকারি দলে থাকছে। এটা হলো নিউ বেনিফিসিয়াল ডেমোক্রেসি।’ বঙ্গভবনে মন্ত্রিসভার শপথ গ্রহণের অনুষ্ঠানে ঢোকার আগে সাংবাদিকদের একথা বলেন রফিক-উল হক।
কলামনিস্ট সৈয়দ আবুল মকসুদ শপথ অনুষ্ঠানের পর প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, নতুন সরকার গোঁজামিলের সরকার। জাতীয় পার্টি সরকারেও আছে, বিরোধী দলেও আছে। জাতীয় পার্টি একটি সুবিধাবাদী দল। তাদের এই স্ট্যান্ডবাজিতে তারা গৃহপালিত নয়, তার চেয়েও বেশি জঘন্য বিরোধীদলে পরিণত হয়েছে। সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন এর সাধারণ সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদারের কাছে নতুন এ মন্ত্রিসভা ‘জগাখিচুড়ি’র মতো। সংসদের বিরোধী দলের প্রতিনিধিরা সরকারে যুক্ত হওয়ায় নতুন বিতর্ক সৃষ্টি হতে পারে বলে তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি। তার মতে, এটি সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। রাজনৈতিক ভাষ্যকার মীজানুর রহমান শেলী বলেছেন, মন্ত্রিসভায় বিরোধী দলের সদস্যদের উপস্থিতির নজির রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ইতিহাসে দুষ্কর। এটাকে বলা চলে সোনার পাথরবাটি বা কাঁঠালের আমসত্ত্ব, কিংবা নভেল এক্সপেরিমেন্ট (অভিনব পরীক্ষা-নিরীক্ষা)। মন্ত্রিত্ব বঞ্চিত আওয়ামী লীগের নেতা সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত শনিবার বলেছিলেন, ‘আমরা একটি নির্ভেজাল বিরোধী দল চাই, যারা সরকারের গঠনমূলক সমালোচনা করবে। মাথাটা সরকারি দলের, আর লেজটা বিরোধী দলের, এটা করা যাবে না। মাথা-লেজ বিরোধী দলের আর পেট সরকারি দলের; এটাও হবে না, হয়ও না। সবাই যদি মন্ত্রিত্বের জন্য কাঙাল হয়ে পড়ি, তাহলে গণতন্ত্রের কাঙাল হবে কে?’
এদিকে সরকারের শপথের কয়েক ঘণ্টার মধ্যে সন্ধ্যায় জাপা চেয়ারম্যান এরশাদকে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে সরকার। প্রজ্ঞাপন জারি করে এ সিদ্ধান্তের কথা জানায় মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। এছাড়া প্রধানমন্ত্রীর ছয় উপদেষ্টাকে অব্যাহতি দিয়ে চারজনকে আবারও প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এদের মধ্যে রয়েছেন রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম, অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমান, পররাষ্ট্র উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভী ও সামরিক উপদেষ্টা তারেক আহমেদ সিদ্দিকী।
নতুন সরকারের স্থায়ীত্বের ব্যাপারে গভীর সংশয়ের মধ্যে শপথ নেয়া মন্ত্রীদের মধ্যে দফতরও বণ্টন করা হয়েছে অস্বাভাবিক দ্রুততায়। শপথ নেয়ার ১ ঘণ্টার মধ্যেই নতুন মন্ত্রিপরিষদের দফতর বণ্টন করে গেজেট প্রকাশ করা হয়েছে। সন্ধ্যর পর মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। প্রধানমন্ত্রী নিজের কাছে রেখেছেন গুরুত্বপূর্ণ স্বরাষ্ট্র, পররাষ্ট্র, প্রতিরক্ষা, জ্বালানির মতো মন্ত্রণালয়গুলো। স্বরাষ্ট্র ও পররাষ্ট্রতে প্রতিমন্ত্রী দেয়া হয়েছে। 
মন্ত্রীদের মধ্যে তোফায়েল আহমেদ-বাণিজ্য, মোহাম্মদ নাসিম-স্বাস্থ্য, আনিসুল হক-আইন, অধ্যক্ষ মতিউর রহমান-ধর্ম, এডভোকেট কামরুল ইসলাম-খাদ্য, রাশেদ খান মেনন বেসামরিক বিমান ও পর্যটন, আসাদুজ্জামান নূর-সংস্কৃতি, আনোয়ার হোসেন মঞ্জু-পরিবেশ ও বন, আবুল মাল আবদুল মুহিত- অর্থ, সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম-স্থানীয় সরকার, মতিয়া চৌধুরী-কৃষি, নুরুল ইসলাম নাহিদ-শিক্ষা, হাসানুল হক ইনু-তথ্য, ওবায়দুল কাদের-যোগাযোগ, মুজিবুল হক-রেল, খন্দকার মোশাররাফ হোসেন- প্রবাসী কল্যাণ, আবদুল লতিফ সিদ্দিকী- ডাক ও টেলিযোগাযোগ, ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন-গৃহায়ণ ও গণপূর্ত, আকম মোজাম্মেল হক- মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক, ছায়েদুল হক- মত্স্য ও প্রাণিসম্পদ, ইমাজ উদ্দিন প্রামাণিক- বস্ত্র ও পাট, ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ- পানিসম্পদ, শাহজাহান খান- নৌ পরিবহন, মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া- ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, আ হ ম মুস্তফা কামাল (লোটাস কামাল)- পরিকল্পনা, মোস্তাফিজুর রহমান- প্রাথমিক ও গণশিক্ষা, সৈয়দ মহসিন আলী- সমাজকল্যাণ, শামসুর রহমান শরিফ- ভূমি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পেয়েছেন।
এছাড়া প্রতিমন্ত্রী হিসেবে মুজিবুল হক চুন্নু- শ্রম, ইয়াফেস ওসমান- বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, এম এ মান্নান- অর্থ, মির্জা আজম- পাট ও বস্ত্র, প্রমোদ মানকিন- সমাজকল্যাণ, বীর বাহাদুর উশৈসিং- পার্বত্য চট্টগ্রাম, নারায়ণ চন্দ্র চন্দ- মত্স্য ও প্রাণিসম্পদ, বীরেন শিকদার- যুব ও ক্রীড়া, আসাদুজ্জামান খান- স্বরাষ্ট্র সাইফুজ্জামান চৌধুরী- ভূমি, ইসমত আরা সাদেক- প্রাথমিক ও গণশিক্ষা, মেহের আফরোজ- মহিলা ও শিশু, মশিউর রহমান রাঙ্গা- পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়, শাহরিয়ার আলম- পররাষ্ট্র, জাহিদ মালেক- স্বাস্থ্য, নসরুল হামিদ- বিদ্যুত্ ও জুনাইদ আহমেদ পলক- তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পেয়েছেন। উপমন্ত্রী আবদুল্লাহ আল ইসলাম জ্যাকব- পানিসম্পদ ও আরিফ খান জয় যুব মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পেয়েছেন। 
বিগত মহাজোট সরকারে আলোচিত-সমালোচিত ও দাপুটে অনেক মন্ত্রীর স্থান হয়নি নতুন মন্ত্রিসভায়। বাদপড়া মন্ত্রীদের মধ্যে রয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর, পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি, পরিবেশ ও বনমন্ত্রী হাছান মাহমুদ, পরিকল্পনামন্ত্রী এ কে খন্দকার, শিল্পমন্ত্রী দিলীপ বড়ুয়া, স্বাস্থ্যমন্ত্রী আ ফ ম রুহুল হক, প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী আফসারুল আমীন, পানিসম্পদমন্ত্রী রমেশ চন্দ্র সেন, মত্স্যমন্ত্রী আবদুল লতিফ বিশ্বাস, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিমন্ত্রী মোস্তফা ফারুক মোহাম্মদ, খাদ্যমন্ত্রী আবদুর রাজ্জাক, বিমান ও পর্যটনমন্ত্রী ফারুক খান, শ্রমমন্ত্রী রাজিউদ্দিন আহমেদ, একসময়ের রেলমন্ত্রী ও পরে দফতরবিহীন মন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, নির্বাচনকালীন সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলী, ভূমিমন্ত্রী রেজাউল করিম হীরা, সংস্কৃতিমন্ত্রী আবুল কালাম আজাদ, ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী সাহারা খাতুন ও আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ। 
এছাড়া গত সরকারের যেসব প্রতিমন্ত্রী বাদ পড়লেন তারা হলেন, স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকু, স্থানীয় সরকার প্রতিমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক, ধর্ম প্রতিমন্ত্রী শাহাজাহান মিয়া, পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী দীপংকর তালুকদার, পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী মাহবুবুর রহমান, বিদ্যুত্ প্রতিমন্ত্রী এনামুল হক, স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী মজিবুর রহমান ফকির, ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী আহাদ আলী সরকার, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী তাজুল ইসলাম, শিল্প প্রতিমন্ত্রী ওমর ফারুক চৌধুরী, শ্রম প্রতিমন্ত্রী মন্নুজান সুফিয়ান, মত্স্য প্রতিমন্ত্রী আবদুল হাই, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী মোতাহার হোসেন ও গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী আবদুল মান্নান খান।
এদের অনেকেই প্রধানমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত ছিলেন। আবার দলেও বেশ প্রভাবশালী ছিলেন। আওয়ামী লীগের বেশ কয়েকটি সূত্র জানিয়েছে, আগের সরকারে থাকা বেশ কয়েকজন মন্ত্রীর বিরুদ্ধে অতিকথন এবং প্রচুর সম্পদ অর্জনসহ নানা বিতর্ক ওঠায় আপাতত সুশীল সমাজের গ্রহণযোগ্যতা পেতে তাদের মন্ত্রিসভায় রাখা হয়নি।
নতুন মন্ত্রিসভার বৈশিষ্ট্য হচ্ছে- আওয়ামী লীগের তিন হেভিওয়েট নেতা তোফায়েল আহমেদ, আমির হোসেন আমু এবং মোহাম্মদ নাসিম মন্ত্রিসভায় জায়গা পেয়েছেন। ২০০৯ সালের মন্ত্রিসভায় এই তিনজনের কেউই জায়গা পাননি ‘সংস্কারপন্থী’ হওয়ার অভিযোগে। অবশ্য এবারের নির্বাচনকালীন মন্ত্রিসভায় ছিলেন তোফায়েল ও আমু। এর আগে মন্ত্রিসভা সম্প্রসারণের সময় তোফায়েল আহমেদকে মন্ত্রিসভায় যোগ দেয়ার প্রস্তাব দেয়া হলেও প্রত্যাখ্যান করেছিলেন তিনি। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগের মন্ত্রিসভার বহুল বিতর্কিত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম এবং দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটনমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশারফ হোসেন একযুগ পর ফিরেছেন শেখ হাসিনার নতুন মন্ত্রিসভায়।
ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেননও নির্বাচনকালীন মন্ত্রিসভায় ছিলেন। তিনিও আগে মন্ত্রিসভা সম্প্রসারণের সময় মন্ত্রিত্বের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। নির্বাচনকালীন সরকারে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মেনন এবার পেয়েছেন বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয়। 
১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার ঐকমত্যের সরকারের যোগাযোগমন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জু এবার বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয় পেয়েছেন। নির্বাচনকালীন সরকারে তিনি উপদেষ্টা ছিলেন। 
১৯৯৬ সালের আরেক বিতর্কিত প্রতিমন্ত্রী ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া ১২ বছর পর শেখ হাসিনার সরকারে ফিরেছেন ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের পূর্ণমন্ত্রী হিসেবে। মায়াপুত্র দীপু চৌধুরীর সন্ত্রাস ও দখলের রাজত্ব ২০০১ সালে আওয়ামী লীগের ভরাডুবিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে বলে মনে করা হয়। 
শেয়ারবাজারসহ নানা বিষয়ে বিতর্কিত বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের সাবেক সভাপতি আ হ ম মুস্তফা কামাল (লোটাস কামাল) মন্ত্রিসভায় স্থান পাওয়ার বিষয়টি আলোচিত হচ্ছে। শেখ মুজিব হত্যাকাণ্ড, বিডিআর হত্যাকাণ্ডসহ বেশ কয়েকটি মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান আইনজীবী আনিসুল হককে আইন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। আনিসুল হক কট্টরপন্থী হিসেবে পরিচিত।
নতুন মন্ত্রিত্ব পেয়েছেন নওগাঁ-৪ আসনের ইমাজউদ্দিন প্রামাণিক, পাবনা-৪ আসনের এমপি শামসুর রহমান শরিফ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া-১ আসনের এমপি ছায়েদুল হক এবং মৌলভীবাজার-৩ আসনের এমপি সৈয়দ মহসীন আলী। ময়মনসিংহের আওয়ামী লীগ নেতা অধ্যক্ষ মতিউর রহমান টেকনোক্র্যাট কোটায় মন্ত্রিত্ব পেয়েছেন। আওয়ামী লীগের সাবেক এই এমপি এবার দলীয় মনোনয়ন পাননি। তার আসনে জাতীয় পার্টির রওশন এরশাদ নির্বাচিত হয়েছেন। মনোনয়ন বঞ্চনার পুরস্কার হিসেবে তাকে মন্ত্রিত্ব দেয়া হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। 
প্রতিমন্ত্রী হিসেবে প্রথমবারের মতো স্থান পেয়েছেন আওয়ামী লীগের সাইফুজ্জামান চৌধুরী (চট্টগ্রাম-১৩), জাহিদ মালেক (মানিকগঞ্জ-৩), নারায়ণ চন্দ্র চন্দ (খুলনা-৫), জুনাইদ আহমেদ পলক (নাটোর-৩), এম এ মান্নান (সুনামগঞ্জ-৩), নসরুল হামিদ বিপু (ঢাকা-৩), মির্জা আজম (জামালপুর-৩), বীরেন শিকদার (মাগুরা-২), বীর বাহাদুর উশৈসিং (বান্দরবান), আসাদুজ্জামান খান কামাল (ঢাকা-১২), ইসমত আরা সাদেক (যশোর-৬), শাহরিয়ার আলম (রাজশাহী-৬) ও জাতীয় পার্টির মসিউর রহমান রাঙ্গা (রংপুর-১) এবং মুজিবুল হক চুন্নু (কিশোরগঞ্জ-৬)। এর মধ্যে সাইফুজ্জামান চৌধুরী আওয়ামী লীগের সাবেক প্রেসিডিয়াম সদস্য আক্তারুজ্জামান চৌধুরী বাবুর ছেলে। আর ইসমত আরা সাদেক শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন প্রথম সরকারের শিক্ষামন্ত্রী এ এস এইচ কে সাদেকের স্ত্রী।
উপমন্ত্রী হিসেবে জায়গা পাওয়া ভোলা-৪ আসনের এমপি আবদুল্লাহ আল ইসলাম জ্যাকব তোফায়েল আহমেদের ঘনিষ্ঠজন এবং নেত্রকোনা-২ আসনের এমপি জাতীয় ফুটবল দলের সাবেক অধিনায়ক আরিফ খান জয় ক্রীড়াঙ্গনের তারকা।

বিশ্ব ইজতেমার উৎপত্তি ও বিকাশ

উপমহাদেশের মুসলমানবিশ্ব ইজতেমায় যোগ দিতে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে টঙ্গী ইজতেমা মাঠে আসতে শুরু করেছেন মুসল্লিরা। গতকাল দুপুরে তোলা ছবি ।  প্রথম আলোদের ইতিহাসের এক ক্রান্তিলগ্নে তাবলিগ জামাতের শুভ সূচনা হয়। বিংশ শতাব্দীর প্রখ্যাত ইসলামি চিন্তাবিদ ও সাধক হজরত মাওলানা ইলিয়াস আখতার কান্ধলভি (১৮৮৫-১৯৪৪ খ্রি.) দাওয়াতে তাবলিগ জামাতের পুনর্জাগরণ করেন। তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী দিল্লির দক্ষিণ পাশে অবস্থিত এক জনবিরল নীরব অঞ্চল ‘মেওয়াত’। চারিত্রিক বিপর্যস্ত ধর্মকর্মহীন, অশিক্ষিত ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন নামেমাত্র মুসলমান ‘মেও’ জনগোষ্ঠীকে ইসলামের মৌলিক বিশ্বাস, ধর্মের পূর্ণাঙ্গ অনুশীলন ও কালেমার দাওয়াতি মর্ম শিক্ষাদান এবং বিভ্রান্তির কবল থেকে মুক্ত করার লক্ষ্যে হজরত মাওলানা ইলিয়াস (রা.) তাবলিগ জামাতের কার্যক্রম শুরু করেন। ১৩৪৫ হিজরিতে দ্বিতীয় হজ থেকে ফিরে এসে তিনি তাবলিগি গাশ্ত শুরু করলেন, জনসাধারণের মধ্যে কালেমা ও নামাজের দাওয়াত দিতে লাগলেন। তাবলিগ জামাত বানিয়ে বিভিন্ন এলাকায় বের হওয়ার দাওয়াত দিলেন, এভাবে গ্রামে গ্রামে সৎ কাজ করার জন্য জামাত তৈরি করে দিতেন। কয়েক বছর মেওয়াতে এ পদ্ধতিতে দাওয়াতি কাজ অব্যাহত থাকল।
১৩৫২ হিজরিতে তৃতীয় হজ পালনের পর তিনি বুঝতে পারলেন যে গরিব মেওয়াতি কৃষকদের পক্ষে দ্বীন শেখার সময় পাওয়া কষ্টকর। ঘরসংসার ছেড়ে মাদ্রাসায় দ্বীন শেখাও অসম্ভব। ওয়াজ-নসিহতের মাধ্যমে সামগ্রিক জীবন পাল্টে দেওয়া বা জাহেলি বিশ্বাসকে পরিবর্তন করাও সম্ভব নয়। তাই ক্ষুদ্র দল বা ছোট জামাত আকারে ইলমি ও দ্বীনি প্রতিষ্ঠানগুলোয় গিয়ে সময় কাটানোর জন্য উদ্বুদ্ধ করলেন এবং ধর্মীয় পরিবেশে তালিম দিতে আরম্ভ করলেন। সেসব ধর্মীয় মজলিসে ওলামা-মাশায়েখদের ওয়াজ-নসিহতের পাশাপাশি তাদের দৈনন্দিন জীবনের নিয়মনীতি বাতলে দেওয়া হতো। মানুষ দ্বীনদার পরহেজগার লোকদের জীবনযাপন, কথাবার্তা, আচার-আচরণ, চালচলন গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করতেন। শুরুতে তাবলিগি কার্যক্রম ব্যাপক সমর্থন পায়নি, কিন্তু ধীরে ধীরে এর জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পায়।
রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর মুখ নিঃসৃত শাশ্বত বাণী: ‘তোমার কাছে যদি কোনো বাণী থাকে, তা অন্যের কাছে পৌঁছে দাও।’ এ দাওয়াতি আহ্বানকে কেন্দ্র করেই পর্যায়ক্রমে তাবলিগের বিশ্বব্যাপী প্রচার ও প্রসার ঘটে। এ ব্যাপারে তাবলিগ জামাতের প্রতিষ্ঠাতা হজরত মাওলানা ইলিয়াস (রা.) অত্যন্ত ন্যায়নিষ্ঠা, ধৈর্য, পরিশ্রম, পরিকল্পনা ও দিকনির্দেশনায় অপরিসীম ভূমিকা রাখেন। তাবলিগ জামাতের দ্বিতীয় আমির মাওলানা ইউসুফ কান্ধলভি (রা.)-এর যুগে ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশে এ আন্দোলন সবচেয়ে বেশি ও শক্তিশালী ছিল। প্রথম ইজতেমা ১৯৪১ সালে দিল্লির নিজামউদ্দীন মসজিদের ছোট এলাকা মেওয়াতের নুহ মাদ্রাসায় আয়োজন করা হয়। এতে প্রায় ২৫ হাজার তাবলিগ দ্বীনদার মুসলমান অংশ নেন। এভাবে অত্যন্ত ক্ষুদ্র পরিসরে মেওয়াতের বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার কিছু মানুষের কাছে দ্বীনের কথা প্রচারের মধ্য দিয়ে তাবলিগ জামাতের যাত্রা শুরু হয়।
বাংলাদেশে ১৯৪৬ সালে ঢাকার রমনা পার্কসংলগ্ন কাকরাইল মসজিদে তাবলিগ জামাতের বার্ষিক সম্মেলন বা ইজতেমা প্রথম অনুষ্ঠিত হয়। এরপর ১৯৪৮ সালে চট্টগ্রামে তৎকালীন হাজি ক্যাম্পে ইজতেমা হয়, ১৯৫৮ সালে বর্তমান নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয়। তখন এটা কেবল ইজতেমা হিসেবে পরিচিত ছিল। প্রতিবছর ইজতেমায় অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা আশাতীতভাবে বাড়তে থাকায় ১৯৬৬ সালে ইজতেমা টঙ্গীর পাগার গ্রামের খোলা মাঠে আয়োজন করা হয়। ওই বছর স্বাগতিক বাংলাদেশ ছাড়াও বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা অংশ নেওয়ায় ‘বিশ্ব ইজতেমা’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। ১৯৬৭ সাল থেকে বর্তমান অবধি (২০১১ সাল থেকে দুই পর্বে) ‘বিশ্ব ইজতেমা’ টঙ্গীর কহর দরিয়াখ্যাত তুরাগ নদের উত্তর-পূর্ব তীরসংলগ্ন ডোবা-নালা, উঁচু-নিচু মিলিয়ে রাজউকের হুকুমদখলকৃত ১৬০ একর জায়গার বিশাল খোলা মাঠে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। প্রতিবছর বাংলাদেশের প্রত্যন্ত গ্রাম-শহর-বন্দর থেকে লাখ লাখ ধর্মপ্রাণ মুসলমান এবং বিশ্বের প্রায় ৫০ থেকে ৫৫টি দেশের তাবলিগি দ্বীনদার মুসলমান জামাতসহ ২৫ থেকে ৩০ লক্ষাধিক মুসল্লি বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম আন্তর্জাতিক ইসলামি মহাসম্মেলন বা বিশ্ব ইজতেমায় অংশ নেন। সাধারণত প্রতিবছর জানুয়ারি মাসের তৃতীয় সপ্তাহের শুক্রবার আমবয়ান ও বাদ জুমা থেকে বিশ্ব ইজতেমার কার্যক্রম শুরু হয়।
বিশ্ব ইজতেমার প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে, তিন দিন দেশ-বিদেশের ইমানদার ত্যাগী আলেম-ওলামাদের কাছ থেকে পবিত্র কোরআন ও হাদিসের আলোকে বয়ান শুনে আখেরি মোনাজাত করে ইমান-আমলের দাওয়াত সারা বিশ্বে পৌঁছে দেওয়া। শুধু ইসলামি বয়ান শোনা কিংবা আখেরি মোনাজাতে প্রচুর লোকজনের অংশগ্রহণ করা ইজতেমার মূল উদ্দেশ্য নয়। লক্ষ্য হলো, যাতে বেশি তাবলিগ জামাত বের হয়। প্রতিবছর এক হাজার ৫০০ থেকে এক হাজার ৭০০ জামাত বিশ্ব ইজতেমা থেকে দেশে-বিদেশে এক চিল্লা (৪০ দিন), তিন চিল্লা (চার মাস), ছয় মাস ও এক বছরের জন্য আল্লাহর দ্বীনের তাবলিগ ও দাওয়াতের জন্য বের হয়। তাবলিগের প্রতি জামাতে ১৪ থেকে ১৫ জন মুসল্লি থাকেন। জামাত বের হওয়ার উদ্দেশ্য হচ্ছে প্রথমত, জামাতের সাথিদের ইমান-আমল ও ইলম অর্জন করা এবং আত্মশুদ্ধি হওয়া। দ্বিতীয়ত, প্রতিটি মসজিদ থেকে জামাত বের করা। তৃতীয়ত, প্রতিটি মসজিদে পাঁচ আমল পরিপূর্ণ চালু করা (সপ্তাহে দুই দিন গাশ্ত করা, প্রতিদিন মাশওয়ারা করা, প্রতিদিন আড়াই ঘণ্টা দ্বীনের দাওয়াত দেওয়া, প্রতিদিন মসজিদ ও বাড়িতে তালিম করা এবং মাসে তিন দিন তাবলিগে যাওয়া)। প্রতিটি জামাত নির্ধারিত এলাকার প্রতি মসজিদে দুই-তিন দিন করে থেকে তাওহিদ, রিসালাত, আখিরাত, ইমান ও আমলের দাওয়াত দেওয়া। এ বছর দেশের প্রতিটি মসজিদ থেকে একটি করে তাবলিগ-জামাত বের করার লক্ষ্য নিয়ে ৪৯তম বিশ্ব ইজতেমা অনুষ্ঠিত হচ্ছে।

মঙ্গলবার, ৭ জানুয়ারী, ২০১৪

আওয়ামী রাজনীতিতে নতুন উত্থান আবু রেজা নদভী

আওয়ামী রাজনীতিতে নতুন উত্থান ড. আবু রেজা নদভী। নির্বাচনের দুই মাস আগে আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন নিয়ে চট্টগ্রামের রাজনৈতিক অঙ্গনে হৈ-চৈ ফেলে দেন। জীবনে প্রথম নির্বাচন করে নতুন এ রাজনীতিবিদ এবার জামায়াত অধ্যুষিত এলাকা হিসেবে পরিচিত চট্টগ্রাম-১৫ (লোহাগাড়া-সাতকানিয়া) আসনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে আবারো আলোচনার টেবিলে চলে এসেছেন। ১৯৭৩ সালের প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর বিগত ৪১ বছরে আওয়ামী লীগের কেউই এ আসন থেকে নির্বাচিত হতে পারেননি। এমনকি গত ৮টি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের কোন প্রার্থী শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতাও গড়ে তুলতে পারেন নি। এমনকি বিগত ২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী একেএম সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী তৃতীয় হয়েছিলেন। তিনি ভোট পেয়েছিলেন ৪৯ হাজার ৪৭২ ভোট।
গত ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী ড. আবু রেজা মো. নেজাম উদ্দিন নদভী ১ লাখ ১ হাজার ৮৬৬ ভোট পেয়ে সাতকানিয়া-লোহাগাড়া আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনএফের জয়নাল আবেদীন কাদেরী পেয়েছেন ৪ হাজার ৪৪৮ ভোট। গত ৪১ বছর আগে ১৯৭৩ সালের প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী এন সিদ্দিক নির্বাচিত হয়েছিলেন। এরপর থেকে এ আসনটি আওয়ামী লীগের অধরাই থেকে যায়। আওয়ামী লীগ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলেও বারবার পরাজয়ের স্বাদ নিতে হয়েছে। ১৯৯১, ২০০১ এবং ২০০৮ সালের নির্বাচনে এ আসনে জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থী জয়লাভ করেন। ১৯৯৬ সালে জয়লাভ করেন বিএনপির প্রার্থী।
পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, চট্টগ্রাম-১৫ (সাতকানিয়া-লোহাগাড়া) আসনে ২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থী চট্টগ্রাম মহানগর আমীর আ ন ম শামসুল ইসলাম ১ লাখ ২০ হাজার ৩৩৯ ভোট পেয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তাঁর নিকটতম প্রার্থী এলডিপি’র চেয়ারম্যান কর্নেল ড. অলি আহমেদ পেয়েছেন ৬৩ হাজার ৪১২ ভোট। এ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী একেএম সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী হয়েছেন তৃতীয়। তিনি ভোট পান ৪৯ হাজার ৪৭২ ভোট। এর আগে ১৯৯১ ও ২০০১ সালের নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামীর আলহাজ শাহজাহান চৌধুরী, ১৯৯৬ সালে তৎকালীন বিএনপির কর্নেল ড. অলি আহমেদ, ১৯৮৬ ও ১৯৮৮ সালে জাতীয় পার্টির ইব্রাহিম বিন খলিল, ১৯৭৯ সালে বিএনপির মোস্তাক আহমেদ এবং ১৯৭৩ সালের প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের এম সিদ্দিক নির্বাচিত হয়েছিলেন।

এদিকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর অধ্যাপক ড. আবু রেজা মুহাম্মদ নেজাম উদ্দিন নদভীর কর্মী-সমর্থকরা নতুন করে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছেন। ইতিমধ্যে তারা বলাবলি শুরু করেছেন নতুন সরকারের মন্ত্রী পরিষদে আবু  রেজা নদভী স্থান পাচ্ছেন। তিনি হবেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সাথে তাঁর সম্পর্ক ভাল। আওয়ামী লীগ সরকার তাঁর এই সম্পর্ক কাজে লাগিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সাথে আওয়ামী লীগের সম্পর্ক আরো জোরালো করতে চায়।

সাধারণ মানুষের সাথে কথা বলে জানা গেছে, আওয়ামী লীগের প্রার্থী অধ্যাপক ড. আবু রেজা মুহাম্মদ নেজাম উদ্দিন নদভীকে আওয়ামী লীগের সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্বাচনের আগে ডেকে নিয়ে মনোনয়ন দেন। এরপর তিনি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন। বিরোধীদল বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী এ নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করলে সুবিধা পেয়ে যান আবু রেজা নদভী। নির্বাচনে তিনি বিপুল ভোটে জয়লাভ করেন। একতরফা নির্বাচনে তিনি জয়লাভ করলেও রাজনৈতিক বোদ্ধাদের মতে- সাতকানিয়া-লোহাগাড়া আসনে নদভীর রাজনীতির যাত্রা শুরু। ধীরে ধীরে তিনি দলকে এই এলাকায় শক্তিশালী হিসেবে গড়ে তুলবেন। এলাকায় নিজেকে নিয়ে যাবেন শক্ত অবস্থানে।
আল্লামা ফজলুল্লাহ ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে অধ্যাপক ড. আবু রেজা মুহাম্মদ নেজাম উদ্দিন নদভী দীর্ঘ এক যুগেরও বেশি সময় ধরে প্রায় সাড়ে ৫ হাজার নতুন মসজিদ, মাদরাসা, এতিমখানা, হেফজখানা, অজুখানা, শিক্ষাভবন নির্মাণ, নলকূপ স্থাপন, ইফতার ও কোরবানি কর্মসূচির মাধ্যমে অসহায় ও দুঃস্থদের মাঝে ইফতার সামগ্রী ও কোরবানির মাংস বিতরণ, এতিম পুনর্বাসন, গৃহনির্মাণ, হজ কর্মসূচি, দারিদ্র বিমোচন ও কর্মসংস্থান, দরিদ্র নারীদের বিয়ের সহযোগিতা, কারিগরি প্রশিক্ষণ, স্বাস্থ্যখাতে সহযোগিতা, শিক্ষা বৃত্তি প্রদান, নারী ও শিশুর উন্নয়নসহ সমাজ সেবায় অনন্য অবদান রেখে যাচ্ছেন। আল্লামা ফজলুল্লাহ ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে তিনি যত কাজ করেছেন তার ৭০ শতাংশ করেছেন সাতকানিয়া ও লোহাগাড়া উপজেলায়।
আল্লামা ফজলুল্লাহ ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. আবু রেজা মুহাম্মদ নেজামউদ্দিন নদভী ১৯৬৮ সালের ১৫ আগস্ট চট্টগ্রামের সাতকানিয়া উপজেলার মাদার্শা ইউনিয়নের বাবুনগর গ্রামের প্রসিদ্ধ মক্কার বাড়ির সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁরা ৬ ভাই ও ৪ বোন। তিনি ভাইদের মধ্যে চতুর্থ। এক ছেলে ও দুই কন্যা সন্তানের জনক আবু রেজা নদভীর পিতা মরহুম আল্লামা আবুল বারাকাত মুহাম্মদ ফজলুল্লাহ (রহ.) একজন প্রখ্যাত আলেমেদ্বীন ছিলেন। তিনি ১৯৮৭ সালে ভারতের নদওয়াতুল উলামা লক্ষ্ণৌ থেকে বিএ (অনার্স), আরবী ভাষা, সাহিত্য ও ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ হতে দ্বিতীয় শ্রেণি লাভ করেন এবং একই বিশ্ববিদ্যালয় হতে একই বিষয়ে প্রথম শ্রেণিতে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন। এরপর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে (১৯৯৩-৯৪) শিক্ষাবর্ষে আরবী সাহিত্যে এমএ পরীক্ষায় ১ম শ্রেণিতে দ্বিতীয়স্থান লাভ করেন। পরবর্তীতে তিনি ভারতের লক্ষ্ণৌ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি লাভ করেন।

সোমবার, ৬ জানুয়ারী, ২০১৪

চট্টগ্রামে নির্বাচিত হলেন যাঁরা ।। নগরীতে ভোট পড়েছে ২৮ শতাংশ, জেলায় ৫৪ দশমিক ১৬


জনগণ ভোট না দিলেও হয়ে গেল নির্বাচন

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার জেদ সম্পর্কিত প্রচারণাকে আবারও সত্য প্রমাণ করেছেন। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর দাবি শুধু নয়, দেশি-বিদেশি সব মহলের আহ্বানও উপেক্ষা করে তার সরকার গতকাল ৫ জানুয়ারি দশম সংসদ নির্বাচন নামের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করে ছেড়েছে। নির্বাচনের দায়িত্বে নিয়োজিত কর্মকর্তা থেকে পুলিশ এবং বিরোধী দলের নেতা-কর্মীসহ কতজনের প্রাণহানি ঘটেছে, কত নিরীহ মানুষ আহত হয়েছেন এবং কতগুলো ভোটকেন্দ্র পুড়ে ছাই হয়ে গেছে—এসব জানার জন্য অপেক্ষা করতে হবে সত্য, তবে একটি কথা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, নাটকীয়তা যথেষ্ট করা হলেও ভোটাররা ভোটকেন্দ্রে যাননি। যারা গেছেন তাদের নিয়ে অন্তত শতকরার হিসাব কষা যায় না। কারণ, দুপুর পর্যন্তও জানা গেছে, যে কেন্দ্রে ২৫ হাজার ভোটার সে কেন্দ্রে ৪০ থেকে ৫০ জনের বেশি ভোটার ভোট দেননি। এমনটি ঘটেছে খোদ রাজধানীতে। একেও যদি নির্বাচন বলতে হয় তাহলে নিশ্চয়ই তামাশা ধরনের অনেক শব্দকেই ডিকশনারি থেকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করতে হবে।
নির্বাচন যে এরকমই হবে সে সম্পর্কে ক্ষমতাসীনদেরও সুস্পষ্ট ধারণা ছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও নিজেদের অশুভ ইচ্ছা ও পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য তারা শুধু তামাশা করার পথেই পা বাড়াননি, একই সঙ্গে বিরোধী দলকে নির্মূলের ভয়ঙ্কর কর্মকাণ্ডও চালিয়েছেন। মাত্র কয়েকদিনের মধ্যে পুরো দেশকেই তারা মৃত্যুপুরি বানিয়ে ফেলেছিলেন। গণমাধ্যমের খবরে জানার পাশাপাশি প্রত্যক্ষভাবেও জনগণকে সরকারের নিষ্ঠুরতা দেখতে হয়েছে, এখনও হচ্ছে। দেখা গেছে, যৌথ অভিযানের নামে সরকার আসলে বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। কোথাও কোনো অভিযোগ ছাড়াই ডজনে ডজনে গ্রেফতার করা হয়েছে, কোনো কোনো এলাকায় আবার অনেককে মেরেও ফেলা হয়েছে। বিগত কয়েকদিনের প্রতিদিনই মারা গেছেন অসংখ্য নেতা-কর্মী ও সাধারণ মানুষ। অনেককে গুমও করেছে যৌথবাহিনী। এই অভিযানে পুলিশ ও র্যাবের সঙ্গে দেশের সীমান্ত প্রহরার জন্য গঠিত বাহিনী বিজিবিকে তো নামানো হয়েছেই, তাদের সঙ্গে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের গুণ্ডা-সন্ত্রাসী ও ক্যাডাররাও যোগ দিয়েছে। অভিযানে অনেক অচেনা মুখের মানুষকেও দেখা গেছে—যারা বাংলাদেশের নাগরিক নয় বলে অভিযোগ উঠেছে।
এভাবে সব মিলিয়েই দেশে এক ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছিলেন ক্ষমতাসীনরা। বড় কথা, নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষণা দিয়ে সরকার প্রকৃতপক্ষে বিরোধী দলকে নির্মূলের অভিযানই চালিয়েছে। সেনাবাহিনীকে দিয়েও ভয়-ভীতি দেখানোর কৌশল নিয়েছে সরকার। নির্বাচন কমিশনের আড়ালে এবং নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে বাধামুক্ত করার নামে সেনাবাহিনীকে ‘দায়িত্ব’ পালনের জন্য নামানো হয়েছে। অথচ তিনশ’ আসনের মধ্যে ১৫৩ আসনে প্রার্থীরা বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় ‘নির্বাচিত’ হয়ে যাওয়ায় এবং বিরোধী দল অংশ না নেয়ায় বাকি ১৪৭ আসনে স্বাভাবিক প্রতিযোগিতা হওয়ার কোনো সম্ভাবনাই ছিল না। একই কারণে নির্বাচনকেন্দ্রিক সহিংসতার প্রশ্ন তোলা এবং জনগণের শেষ ভরসা সেনাবাহিনীকে নামানোও উচিত হয়নি। কথাটা সাধারণ মানুষের পর্যায়েও ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়েছে। এমন ভাবনার ভিত্তিতেই বলা হচ্ছে, সেনাবাহিনীকে সম্ভবত জনগণের প্রতিপক্ষ বানানোর অতি ভয়ংকর উদ্যোগ নিয়েছিলেন ক্ষমতাসীনরা। এমন অনুমান অকারণে করা হচ্ছে না। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত আন্দোলনকারীদের জঙ্গি-সন্ত্রাসী হিসেবে চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। বলেছেন, তাদের নির্মূল করা হবে। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সুর মিলিয়েছেন আওয়ামী লীগের মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী ও সিনিয়র নেতারা। কেউ অন্দোলনকারীদের ‘দেখা মাত্র’ গুলি করার নির্দেশ দিয়েছেন, কেউ আবার এই বলে হুংকার দিয়েছেন যে, এখন আর প্রতিরোধ বা প্রতিহত করা হবে না বরং নেয়া হবে ‘প্রতিশোধ’। তারা এই প্রতিশোধ নেয়ার জন্য আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের প্রতি হুকুমও জারি করেছেন।
অন্যদিকে বাস্তব পরিস্থিতি কিন্তু ক্ষমতাসীনদের চিন্তা ও পরিকল্পনার অনেক বাইরে চলে গিয়েছিল। বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোটের ডাকে অনেক আগেই অচল হয়ে পড়েছিল সারাদেশ। সবশেষে হরতালের ডাকেও জনগণ সর্বাত্মকভাবে সাড়া দিয়েছে। এরই প্রমাণ পাওয়া গেছে গতকাল। প্রধানমন্ত্রীর সাধের নির্বাচনে তারা ভোটই দিতে যায়নি। এতে অবশ্য ক্ষমতাসীনদের কিছুই যাবে-আসবে না। তারা ঠিকই হিসাব মেলাবেন এবং তার ভিত্তিতে এমন এক পরিসংখ্যান হাজির করবেন যার মাধ্যমে বোঝানো যাবে যে, যথেষ্টসংখ্যক ভোটারই ভোট দিয়েছেন। কিন্তু তাদের এই হিসাব-পরিসংখ্যান এবং চাওয়াটাই শেষ কথা হতে পারে না। কারণ, জনগণ তো সবকিছু দেখেছেই, ওদিকে জাতিসংঘের পাশাপাশি রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও ফ্রান্সসহ ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং গণচীনের মতো শক্তিধর দেশ ও সংস্থাগুলোও—যারা চেয়েছিল, বাংলাদেশে সব দলের অংশগ্রহণে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ অনুষ্ঠিত হোক। প্রধান বিরোধী দল বিএনপি অংশ না নিলে কোনো নির্বাচনই যে তাদের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না সে কথাটাও বিভিন্ন উপলক্ষে জানিয়ে রেখেছে তারা। সুতরাং ক্ষমতাসীনরা চাইলেই দশম সংসদ নির্বাচনকে বৈধ ও অংশগ্রহণমূলক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা যাবে না।
আমরা উদ্বিগ্ন অবশ্য অন্য একটি বিশেষ কারণে। সে কারণটি ক্ষমতাসীনদের, বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রীর প্রকৃত উদ্দেশ্য। ঘটনাপ্রবাহে প্রমাণিত হয়েছে, সাংবিধানিক ধারাবাহিকতার দোহাই দিয়ে তিনি আসলে সুচিন্তিতভাবেই বিরোধী দলকে নির্বাচনের বাইরে ঠেলে দিয়েছেন। কারণ, মোটামুটি নিরপেক্ষ হলেও তার দলের ভরাডুবি তিনি ঠেকাতে পারতেন না। কথা শুধু এটুকুই নয়। তার পরিকল্পনায় রয়েছে দেশকে আবারও একদলীয় শাসনের অন্ধকারে নিয়ে যাওয়া। সেটা করতে হলে সংসদে নিরংকুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা দরকার। সংবিধানের আড়াল নিয়ে প্রধানমন্ত্রী আসলে সেটাই নিশ্চিত করার পদক্ষেপ নিয়েছেন। ফলে আগামী দিনগুলোতে দেশে গণতন্ত্রই শুধু ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে পড়বে না, জনগণের ওপর আবারও চাপানো হতে পারে বাকশালের মতো একদলীয় শাসন। বলা দরকার, গণতন্ত্র যদি না থাকে তাহলে এক পর্যায়ে টান পড়বে দেশের সমগ্র অস্তিত্ব নিয়েও। পরিণতিতে বিপন্ন হবে দেশের স্বাধীনতাও। এ কথাটাই বেগম খালেদা জিয়া তার সর্বশেষ বিবৃতিতে বলেছেন। তিনি সেই সঙ্গে সিকিম এবং লেন্দুপ দর্জির উদাহরণ দিয়েও যা বোঝানোর তা বুঝিয়ে দিয়েছেন। অর্থাত্ গতকালের তথাকথিত নির্বাচনের পরিণতিতে বাংলাদেশ এমনকি তার ‘স্বাধীনতা’ও খুইয়ে বসতে পারে। প্রতিরোধ আন্দোলনও তাই এখন থেকেই গড়ে তোলা দরকার।dainik amerdesh