সোমবার, ১০ মার্চ, ২০১৪

এক পাগলা রাজা এবং ডাইনি মায়ের ইতিকথা!--গোলাম মাওলা রনি সাবেক সংসদ সদস্য

লোকজন এখনো ভেবে পায় নাÑ তাকে কী নামে ডাকবে! পাগল, শয়তান, জালিম, ডাকাত, অমানুষ, পশুÑ নাহ! কোনোটাই যেন তাকে মানায় না। এমনকি সমাজের সব গালি বা মন্দ বাক্য দিয়ে যদি তাকে সম্বোধন করা হয় তবুও যেন পূর্ণতা পায় না তার অপকর্মগুলো। ইতিহাসের এক মহাসন্ধিক্ষণে তিনি ছিলেন দুনিয়ার সবচেয়ে বড় রাজা। সবচেয়ে নামী রাজবংশের রক্তের ধারক, তবুও তিনি ঘৃণিত-জঘন্যভাবে ঘৃণিত হয়ে আসছেন যুগ থেকে যুগান্তরেÑ কাল থেকে কালান্তরেÑ শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে আজ অবধি। তার হাজারো কুকর্ম তাকে হাজারো উপাধিতে ভূষিত করেছে; কিন্তু সবচেয়ে সুন্দরতম উপাধি হলো পাগলা রাজা।
পাগলা রাজার মা যেন তার কুসন্তানের চেয়েও অনেক বেশি খারাপ। তাকেও লোকজন গালাগালি করে অশ্লীল ভাষায়Ñ চরিত্রহীনা, ডাইনি, কুত্তী, বেশ্যাÑ আরো কত কী! কিন্তু তার পরও মানুষের রাগ কমে না। আপনি যদি ভূমধ্যসাগরের দুই পাড়ের রাজ্যগুলোতে যান, তাহলে দেখতে পাবেন সেখানকার লোকেরা দুই হাজার বছর ধরে পাগলা রাজার মায়ের নাম ধরে গালিগালাজ করছে এবং অভিশাপ দিয়েছে। আপনি হয়তো বলবেন লোকজনের গালাগালিতে কী হয়? আমি বলবÑ হয়, অনেক কিছুই হয়! পাগলা রাজা ও তার মায়ের বংশের একজন লোকও পৃথিবীতে বেঁচে নেই, সম্পূর্ণভাবে নির্বংশ হয়েছে পাগলা রাজার গোষ্ঠী। অথচ পৃথিবীর তাবৎ রাজবংশের দুই-চারজন রক্তের ধারক সব সময় বেঁচে থাকে প্রাকৃতিক নিয়মেইÑ ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে।
এখন পাগলা রাজার যত্তসব নষ্টামী, ভ্রষ্টতা ও নিষ্ঠুরতার ইতিবৃত্ত বলব; কিন্তু তার আগে বলে নিই তার ডাইনি মায়ের কাহিনী। তিনি ছিলেন অসাধারণ সুন্দরী, বুদ্ধিমতী ও প্রচ রকম উচ্চাভিলাষী। তার বিকৃত যৌনাচার ও সীমাহীন কামুকতার কাহিনী রাজ্যময় বিস্তৃত ছিলÑ লোকজন সেসব কাহিনী বলাবলি করত আর ভদ্রজনেরা কানে আঙুল দিত অশ্লীল শব্দরাশি থেকে নিজেদের বাঁচানোর জন্য। চার চারটি বিয়ে এবং চারজন স্বামীকেই তিনি বিষ প্রয়োগে হত্যা করেছিলেন। সব শেষে তিনি লোভে পড়ে নিজের বয়োবৃদ্ধ চাচাকে বিয়ে করেছিলেন কেবল রাজ ক্ষমতা কুক্ষিগত করার জন্য। তার প্রতিদ্বন্দ্বী কত নারী ও পুরুষকে যে তিনি খুন করেছিলেন, তা কেউ বলতে পারবেন না। হতে পারে কয়েক শ’ কিংবা কয়েক হাজার। তরুণ ও যুবকদের প্রতি তার ছিল ভারি ঝোঁক। ধরে ধরে পছন্দমতো যুবকদের নিয়ে আসতেন আপন প্রাসাদেÑ তার পর ইচ্ছেমতো কামনা চরিতার্থ করতেন। সেসব হতভাগ্য যাতে কারো কাছে রানীমাতার অভিসারের কথা বলে দিতে না পারে সে জন্য তাদের গুম করে ফেলা হতো; কিভাবে গুম করা হতো তা আজো রহস্যাবৃত।
আমি যার কথা বলছি তার নাম ছিল এগ্রোপিনা। ১৫ খ্রিষ্টাব্দের ৭ নভেম্বর তিনি জন্মেছিলেন। আর মাত্র ৪৩ বছর বয়সে অর্থাৎ ৫৯ খ্রিষ্টাব্দের ২৩ মার্চ মারা গিয়েছিলেন। মারা গিয়েছিলেন মানে মেরে ফেলা হয়েছিল। বহু চেষ্টা-তদবির করে তিনি তার বৃদ্ধ চাচা যিনি ছিলেন সম্রাট, তাকে বিয়ে করলেন। তার পর ছলে-বলে-কৌশলে সিংহাসনের সব উত্তরাধিকারীকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিলেন। বৃদ্ধ সম্রাট কোনো উপায় না দেখে এগ্রোপিনার পূর্বতম স্বামীর ঔরসজাত সন্তানকেই সিংহাসনের উত্তরাধিকারী মনোনীত করলেন। এরপর শুরু হলো অন্য অধ্যায়Ñ এক রাতে দেখা গেল বৃদ্ধ সম্রাট মরে গেছেন আর পরদিন মহাসমারোহে পাগলা রাজা সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হলেন। এর কিছু দিন পর পাগলা রাজা নিজ হাতে তার মাকে হত্যা করে ফেললেনÑ সে এক লম্বা কাহিনী।
পাগলা রাজার মায়ের কাহিনী এবং নাম শোনার পরও হয়তো অনেকে রাজার নামটি ধরতে পারেননি। কিন্তু আমি নিশ্চিতÑ আমি যদি পাগলা রাজার নাম বলি তবে এক কথায় সবাই তাকে চিনতে পারবেন। দুনিয়াতে তার মতো কুকর্ম কেউ করেননি; এমনকি ফেরাউনও নয়। ফেরাউনের বড় দোষÑ সে নিজেকে খোদা দাবি করেছিল। পাগলা রাজাও নিজেকে খোদা দাবি করেছিলেন। পার্থক্য হলো কথিত ফেরাউন দ্বিতীয় রামেসিস আদতে ছিলেন একজন মহাবীর, মহাজ্ঞানী এবং যুদ্ধজয়ী সুশাসক; মিসরবাসী এখনো তাকে মহান রামিসিস বা রামেসিস দ্য গ্রেট বলে ডাকেন। অন্য দিকে পাগলা রাজার অত্যাচারে রাজ্যময় লোক অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। তার জুলুম আর পাগলামিতে আল্লাহর জমিনের মাশরেক থেকে মাগরিব পর্যন্ত তাবৎ ভূখণ্ডের অধিবাসী অভিশাপ বর্ষণ করতে থাকে। ফলে আসমান থেকে নেমে আসে একের পর এক বিপর্যয়। পাগলা রাজার স্বপ্নের প্রাসাদ ভেঙে চুরমার হয়ে যায়Ñ আল্লাহর গজবে তিনি মৃত্যুবরণ করার জন্য চিৎকার করতে থাকেন। পাত্র-মিত্র, চাকর-বাকর সবার হাত-পা ধরতে থাকেন এবং সবাইকে তলোয়ার দিয়ে তাকে হত্যা করার জন্য আকুতি জানাতে থাকেন। কেউ যখন তার অনুরোধে সাড়া দিলেন না, তখনই তিনি পৃথিবীর সেই বিখ্যাত উক্তিটি করেনÑ তবে কি আমার কোনো বন্ধু নেই যে আমার অনুরোধে আমাকে জীবন যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দেয়ার জন্য আমাকে মেরে ফেলতে পারে; কিংবা আমার কি তাহলে কোনো শত্রুও নেই যে কিনা বিুব্ধ হয়ে আমাকে মেরে ফেলতে পারে?
এবার আমি পাগলা রাজার নামটি বলে মূল কাহিনীটি শুরু করি। তার নাম নিরো। পুরো নাম নিরো কডিয়াস সিজার। ‘রোম যখন পুড়ছিল, নিরো তখন বাঁশি বাজাচ্ছিল’Ñ ঐতিহাসিক সেই উপকথাটির নায়ক তিনি। রোমান সাম্রাজ্যের সম্রাট পদে অভিষিক্ত হয়েছিলেন ১৩ অক্টোবর ৫৪ খ্রিষ্টাব্দেÑ যখন তার বয়স ছিল মাত্র ১৭ বছর। রাজত্ব করেছিলেন মোট ১৪ বছর। ৩০ বছর বয়সে অর্থাৎ ৬৮ সালের ৯ জুন রাতে নিজ হাতে নিজের গলায় ছুরি চালিয়ে আত্মহত্যা করার মাধ্যমে এক দিকে যেমন নিজের জীবনের সমাপ্তি ঘটান, অন্য দিকে মহান পূর্বপুরুষ জুলিয়ার্স সিজার প্রতিষ্ঠিত রাজবংশ এবং কডিয়াস সিজার অগাস্টাস সাম্রাজ্যের প্রায় এক শ’ বছরের পুরনো শাসনামলেরও পরিসমাপ্তি ঘটে। তার কুকর্মের অভিশাপে দুনিয়ার কোথাও মহান জুলিয়ার্স সিজারের রক্তের কোনো ধারক খুঁজে পাওয়া যাবে নাÑ এ যেন প্রকৃতির এক দুরন্ত প্রতিশোধ, যা শিক্ষণীয় হয়ে থাকে যুগ-যুগান্তরের অত্যাচারী শাসকদের জন্যÑ যদি তারা আসলেই কিছু শিখতে চায়।
নিরোর চরিত্রের বদ জিনিসগুলো মূলত তার মায়ের চরিত্র থেকে সংক্রমিত হতে থাকে। শিশু নিরো দেখত তার মা দিবানিশি তার বাবাকে অত্যাচার করছে। প্রাসাদের মধ্যেই একের পর এক অপকর্ম করে বেড়াচ্ছে। বিশেষ করে মায়ের যৌনাচারের বিকৃত অভিব্যক্তি নিরোকে শৈশবকাল থেকে নিজ জীবনের প্রতি বীতশ্রদ্ধ করে তোলে। তার শরীরে যৌবনের ছোঁয়া লাগামাত্রই সে নিজেকে নিয়ে মেতে ওঠে ভ্রষ্টাচারে। রক্ত সম্পর্কে তার দাদা ও মায়ের বিয়ের কারণে হঠাৎ দাদা থেকে বাবা হয়ে যাওয়া সম্রাট কডিয়াসও ছিলেন বিকৃত রুচির মানুষ। ফলে নিরোর পক্ষে কোনো অপকর্ম করতে নীতিনৈতিকতার কোনো বাধা ছিল না প্রাসাদের ভেতরে কিংবা বাইরে।
কিশোর নিরো সাঙ্গপাঙ্গসহ রোম নগরীতে ঘুরে বেড়াত এবং ইচ্ছেমতো যার-তার ঘরে ঢুকে পড়ত। পছন্দমতো কোনো মেয়ে পেলে তো কথাই নেই। নিজের ভ্রষ্টতার স্বাক্ষর রেখে আসত সেসব পরিবারের চাপা কান্নার উপযুক্ত জবাব হিসেবে। সারা রোমে তার বিরুদ্ধে ছিঃ ছিঃ রব উঠল। তার মা এগ্রোপিনা ছেলের কুকর্ম কমানোর জন্য অল্প বয়সে তার বিয়ের ব্যবস্থা করলেন। কিন্তু তাতে হিতে বিপরীত হলো। তার কামনা বাসনা দিনকে দিন বাড়তে থাকল। প্রথম স্ত্রী কডিয়া অক্টাভিয়া ছিলেন সম্রাট কডিয়াসের মেয়ে রীতিমতো রোমান রাজরক্তের ধারক। সম্পর্কে নিরোর সৎ বোন; কিন্তু দুশ্চরিত্র নিরো প্রথমে এক ক্রীতদাসীর প্রেমে পড়েন, যার নাম কডিয়া এসিটি। তার পর পপ্পিয়া সাবিনা নামের এক বিবাহিত মহিলার প্রেমে পড়েন এবং একসময় তাকে দ্বিতীয় স্ত্রী হিসেবে বিয়েও করেন। শুধু কি তাই, মেসালিনা ও স্পারস নামের অন্য দুই মহিলাকেও বিয়ে করেন। ফলে অতি অল্প বয়সেই তার বউয়ের সংখ্যা দাঁড়াল চার-এ। তবে অবাক করা বিষয় হলো তার চার নম্বর বউ স্পারস কিন্তু মেয়ে ছিলেন না। তিনি ছিলেন অনিন্দ্য সুন্দর এক বালক ক্রীতদাস। ৬৭ খ্রি. সম্রাট নিরো তাকে বিয়ে করেন সমকামিতার জন্য।
৫৪ খ্রিষ্টাব্দে নিরো সুবিশাল রোমান সাম্রাজ্যের সম্রাট হন। আজকের দুনিয়ার বলতে গেলে সমগ্র ইউরোপ, উত্তর আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য ও ভূমধ্যসাগরের কিছু গুরুত্বপূর্ণ দ্বীপ নিয়ে তার সুবিশাল সাম্রাজ্য ছিল বলে ধনে-জ্ঞানে এবং খ্যাতিতে ছিলেন দুনিয়ার শীর্ষস্থানে। এই রাজ্য পরিচালনার জন্য পাত্র-মিত্র, উজির, নাজির ও সেনাপতি ছাড়াও ছিল শক্তিশালী সিনেট বা সংসদ। নিরোর বয়স যদিও মাত্র ১৭ বছর ছিল তথাপি তিনি ছিলেন অনেক দিক থেকেই দক্ষ এবং অতিমাত্রায় আত্মমর্যাদাশীল। সিনেটের একজন প্রভাবশালী সদস্য ছাড়াও তার দু’জন গুরুত্বপূর্ণ উপদেষ্টা ছিলেন লুসিয়াস ও বুররাস নামে। অন্য দিকে তার মা এগ্রোপিনার প্রভাব তো ছিলই।
সম্রাট নিরো কারো পরামর্শ বা কর্তৃত্ব মেনে নিতে নারাজ। বিশেষ করে তার মায়ের সাথে সম্পর্কের চরম অবনতি হলো। তার মা যখন ছেলের দাম্পত্য জীবনে নাক গলাতে আরম্ভ করলেন, তখনই পরিস্থিতি চলে গেল আয়ত্তের বাইরে। নিরোর প্রথম স্ত্রী অক্টাভিয়া ছিলেন রাজকুমারী। ফলে তিনি নতুন সম্রাটের ভ্রষ্টতা মেনে নিতে পারেননি। সম্রাট তাকে রাজ্য থেকে বের করে একটি নির্জন দ্বীপে নির্বাসনে পাঠান। এ নিয়ে রাজ পরিবার ও অভিজাত মহলে দারুণ প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। সম্রাট কয়েকজন অভিজাত নাগরিককে হত্যা করেন এবং একসময় নিজের মাকেও মেরে ফেলেন।
ক্ষমতা লাভের পাঁচ বছরের মাথায় সম্রাট নিরো অনেকটা অর্ধ উন্মাদের মতো হয়ে যান। বিরোধী মতামত একদম সহ্য করতে পারতেন না। যাকে ইচ্ছে তাকে শাস্তি দিতেন আবার যাকে ইচ্ছে তাকে মেরেও ফেলতেন। সাম্রাজ্যের অভিজাতবর্গকে রাতের আঁধারে ধরে এনে গুম করে ফেলতেন। হঠাৎ করেই তিনি আবিষ্কার করলেন সিনেটে সম্ভবত তাকে নিয়ে চক্রান্ত হচ্ছে। তিনি বিরোধীদলীয় সিনেটেরদের ধরে আনলেন এবং নিজে দাঁড়িয়ে থেকে প্রায় এক শ’ প্রভাবশালী, বয়োজ্যেষ্ঠ এবং রোমান সাম্রাজ্যের কীর্তিমান রাজনীতিবিদদের হত্যা করলেন। এরপর সাম্রাজ্য বিরোধীমুক্ত হয়েছে বলে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলতে লাগলেন।
৬০ সালের পর সম্রাটের বোধ হয় মস্তিষ্ক বিকৃতি ঘটল। তিনি রাত-বিরাত ঘর থেকে বের হন। প্রকাশ্য রাজপথে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে প্রস্রাব করা, গান করা কিংবা চিৎকার করে ভিক্ষা করার মতো নি¤œমানের কাজকর্ম করতে থাকেন। এ সময় তিনি নিজেকে খোদা বলে দাবি করেন। শুধু তা-ই নয়, তিনি বলতে থাকেনÑ ‘এই পৃথিবীতে খোদা বলে যদি কেউ থেকে থাকে তবে সেই খোদার দরকার আছে তার সাহায্য গ্রহণের; কিন্তু তার কোনো দরকার নেই কোনো খোদার সাহায্য।’ তিনি রাস্তাঘাটে চলতে ফিরতে গিয়ে হঠাৎ দাঁড়িয়ে যেতেন, তার পর কোনো পথচারীকে ধরে বলতেনÑ এই তুমি গান করছ কেন? আমাকে নিয়ে ব্যঙ্গ করে গান গাওয়া হচ্ছে? দাঁড়াও দেখাচ্ছি মজা! Ñ এ কথা বলেই তিনি তার সাথে থাকা প্রহরীদের নির্দেশ দিতেন ওই পথচারীর শিরñেদ করার জন্য। পথচারীর মস্তক দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যখন রাজপথের ধুলায় লুটিয়ে পড়ত, তখন সম্রাট নিরো অদ্ভূত এক পৈশাচিক অট্টহাসিতে ফেটে পড়তেন।
তিনি রাজপ্রাসাদে প্রায়ই শাহী ভোজে রোমের অভিজাতবর্গকে পিঠে-পায়েসসহ নানা রকম রাজভোগ খাওয়ানোর জন্য দাওয়াত করতেন। লোকজন এলে তিনি নিজে গান গাইতেন ও নাচতেন। রাজ্যের সম্মানিত বয়স্ক লোকদেরও গান গাইতে এবং নাচতে নির্দেশ দিতেন। তারা যখন সম্রাটের হুকুম পালন করতেন তখন তিনি বুড়োদের বেসুরো গান এবং ধ্যাতাং ধ্যাতাং নাচ দেখে খিলখিলিয়ে ও পিকপিকিয়ে হাসতেন। এর ক’দিন পর তিনি রাজপ্রাসাদ ত্যাগ করে টাইবার নদীর তীরবর্তী একটি রাজকীয় ফলের বাগানে গিয়ে উঠলেন। সেখানে তাঁবু টানিয়ে তিনি প্রিয় স্ত্রী সাবিনাকে নিয়ে থাকতেন। সাবিনার প্রতি নির্দেশ ছিল সম্পূর্ণ বিবস্ত্র হয়ে পালঙ্কের ওপর শুয়ে থাকা। সম্রাট উলঙ্গ স্ত্রীর শরীরের ওপর হালকা একটি চাদর দিয়ে আচ্ছাদনের ব্যবস্থা করতেন। চাদরটি ছিল অতিশয় পাতলা ও মসৃণ, যার ফাঁক দিয়ে সম্রাজ্ঞীর শরীর দেখা যেত। এরপর তিনি সেই তাঁবুর মধ্যে সাক্ষাৎপ্রার্থীদের ডাকতেন। কেউ যদি ভুলক্রমে সম্রাজ্ঞীর উলঙ্গ শরীরের দিকে তাকাতেন তাহলে আর রক্ষা ছিল নাÑ নির্ঘাত মরতে হতো।
এভাবেই সম্রাট নিরোর পাগলামি চলছিল। সম্রাটের পাগলামির শিকার হয়ে পুরো রোমবাসী পাগল হওয়ার উপক্রম হলেন। তার ক্ষমতা লাভের ১০ বছরের মাথায় তিনি ঘটিয়ে ফেললেন ইতিহাসের সবচেয়ে বড় দানবীয় ঘটনা। ’৬৪ সালের ১৮ জুলাই তিনি রোম নগরীতে আগুন ধরিয়ে দিলেন। নগরীর সবচেয়ে বড় বিপণিবিতান সার্কাস মাক্সিমাসে আগুনের সূত্রপাত হলো। ১৯ জুলাই রাত পর্যন্ত মোট ৪৮ ঘণ্টা ধরে রোম নগরী পুড়ে ছারখার হয়ে গেল। কেউ বলে তিনি বাঁশি বাজাচ্ছিলেন আবার কেউ বলে ভায়োলিন।
রোম নগরীর সেই আগুন নিয়ে বহু কথাÑ বহু উপকথা প্রচলিত। কেউ বলেন, রোমের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে লোকজন যখন রোমিউলাসের নাম উচ্চারণ করতেন তখন সম্রাট নিরোর শরীরে হিংসের আগুন জ্বলে উঠত। তিনি চাইতেন নতুন একটি শহর নির্মাণ করে ইতিহাসের মাইলফলক হিসেবে চিহ্নিত হতে। আবার অন্যরা বলেন, রোম নগরীর পুরনো বাড়িঘর ও অলিগলি তার একদম পছন্দ হতো না। তাই তো তিনি পুরনো নগরী জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ছারখার করে নতুন একটি শহর গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন নিজের নাম ও যশকে কৃতীময় করার জন্য।
আগুনে ভস্মীভূত হওয়ার দু-এক মাসের মধ্যেই নিরো নতুন নগরী নির্মাণের কাজে হাত দিলেন। প্রায় ১০ বর্গমাইল এলাকাজুড়ে তৈরি হতে থাকল নতুন ও অত্যাধুনিক শহর। সাম্রাজ্যের বিভিন্ন স্থান থেকে রাতারাতি সংগ্রহ করা হতো কোটি কোটি টন মার্বেল, গ্রানাইডসহ অন্যান্য মূল্যবান পাথর। জড়ো করা হলো লাখ লাখ ক্রীতদাসকে। চলতে থাকল নতুন শহর নির্মাণের কাজ। দিন-রাত ২৪ ঘণ্টা কাজ চলেÑ আর পাগলা সম্রাট একটি ঘোড়ায় চড়ে সেই দৃশ্য দেখেন এবং ভায়োলিন বাজিয়ে গান করেন। এ কাজ করতে করতে তার রাজকোষের সব অর্থভাণ্ডার শেষ হলে গেল। সেনাবাহিনীর বেতনভাতা আটকা পড়ার উপক্রম হলো; কিন্তু তখনো বাকি ছিল সম্রাটের দৃষ্টিতে নতুন দু’টি স্থাপনার নির্মাণ। একটি হলো নিজের জন্য বিলাসবহুল প্রাসাদ আর অন্যটি হলো ৩০ মিটার উচ্চতাবিশিষ্ট তার নিজের একটি ভাস্কর্য।
সম্রাটের অর্থমন্ত্রী অনেক বোঝালেন অর্থসঙ্কটের কথা; কিন্তু পাগলা সম্রাটের জিদÑ না, করতেই হবে ৩০০ একর জায়গার ওপর ‘ডোমাস আউরিয়া’ নামের প্রাসাদ এবং ৩০ মিটার উচ্চতাবিশিষ্ট ভাস্কর্য নির্মাণে ব্যয় ধরা হলো ৩০০ কোটি স্বর্ণমুদ্রা। টাকা কোথায়? পাগলা রাজা হুকুম দিলেন ট্যাক্স বাড়াও এবং রাজ্যের ধনীদের ধন লুট করো। হুকুম তামিল হলো এবং এক দিনের মধ্যে অর্থ সংগ্রহ হয়ে গেল; কিন্তু রাজ্যে দেখা দিলো ভয়াবহ অরাজকতা ও বিদ্রোহ। সম্রাট কঠোরহস্তে বিদ্রোহ দমনের চেষ্টা করলেন। ফলে রোম বিদ্রোহমুক্ত হলো বটে; কিন্তু প্রদেশগুলোতে অশান্তি ছড়িয়ে পড়ল। এভাবে চলল ৬৮ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত। ইতোমধ্যে সম্রাটের শহর, প্রাসাদ ও ভাস্কর্য নির্মাণের কাজ শেষ হলো। সম্রাট ৬৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে মহা ধুমধামে নতুন প্রাসাদে উঠলেন।
মার্চ মাসে গাল্লিয়া প্রদেশের গভর্নর গাইয়াস জুনিয়াস সম্রাটের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করলেন অতিরিক্ত কর আরোপের অভিযোগ তুলে। সম্রাট স্বয়ং যুদ্ধের ময়দানে উপস্থিত হলেন। পরিস্থিতি তার প্রতিকূলে চলে যাওয়ায় তিনি রোমে পালিয়ে এলেন। তিনি দুপুরের দিকে তার প্রাসাদে ফিরে ঘুমিয়ে পড়লেন। মাঝ রাতে জেগে দেখেন প্রাসাদের সব রক্ষী পালিয়ে চলে গেছে। এরপর তিনি প্রাসাদের বিভিন্ন কক্ষে অবস্থানরত তার বন্ধু-বান্ধবদের খোঁজ করলেন। দেখলেন কেউ নেইÑ সবাই তাকে ছেড়ে পালিয়েছে। এরপর তিনি চিৎকার করে বললেনÑ কেউ কি আছো যে আমাকে তার তলোয়ার দিয়ে হত্যা করতে পারে। প্রাসাদ বেদিতে তার আর্তচিৎকার প্রতিধ্বনিত হলো; কিন্তু কেউ এলো না।
সম্রাট পাগলের মতো প্রাসাদ থেকে দৌড়ে বের হয়ে এলেন গভীর রাতে। তারই প্রতিষ্ঠিত শহরের অলিগলিতে চিৎকার করলেন। কেউ তার জন্য দরজা খুলল না। ইতোমধ্যে তার চারজন বিশ্বস্ত চাকর ও বালক স্ত্রী স্পারস এগিয়ে এলেন। সম্রাট তাদের কবর খোঁড়ার জন্য নির্দেশ দিলেন। এমন সময় সম্রাটের কাছে খবর এলোÑ রোমান সিনেট তাকে গণশত্রু আখ্যা দিয়ে গ্রেফতারের নির্দেশ দিয়েছে। এ খবর শুনে নিজেকে আর স্থির রাখতে পারলেন না। নিজের চাকু দিয়ে নিজের গলার রগ কেটে আত্মহত্যা করলেন। মৃত্যুর সময় উচ্চারণ করলেন সেই বিখ্যাত বাণীÑ ‘কুয়ালিস আর্টিফেক্স পিরিও’। ইংরেজিতে যার অর্থ দাঁড়ায়Ñ "What an artist dies in me."  তারিখটি আবার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছিÑ ৬৮ সালের ৯ জুন, সময় ভোররাত। স্থান : রাজপথ।

প্রেম দিয়েছ তুমি কিন্তু পানি দিতে পারলাম না আমি-অলিউল্লাহ নোমান

ঐতিহাসিক ৭ মার্চ উপলক্ষে আওয়ামী লীগ আয়োজিত আওয়ামী লীগের জনসভা। সভানেত্রী শেখ হাসিনা প্রধান অতিথির ভাষণ দিলেন। শিক্ষণীয় অনেক বাণী দিয়েছেন। তার স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতেই সব কথা বলেছেন। ভোটারবিহীন জবরদস্তির নির্বাচনে বিজয়ী প্রধানমন্ত্রী তিনি। তার বক্তব্য ভবিষ্যত্ প্রজন্মের জন্য অনেক শিক্ষণীয়। শব্দচয়নে ছিল সাহিত্যের ছোঁয়া।
বাংলা সাহিত্যের ছাত্রী ছিলেন এমনটাই দাবি তার। তারই প্রভাব বক্তব্যের পরতে পরতে। যদিও দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের হলফনামায় দেখা যায় শিক্ষাগত যোগ্যতা বিএ। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রাপ্ত নাম্বার নিয়ে বেরসিক সমালোচকরা নানা কথা বলে বেড়ান। বেরসিকদের কেউ কেউ ঠাট্টা করে বলেন ৩ পেয়েছিলেন। মাস্টার সাহেবকে বাড়িতে ডেকে এনে সেটা ৩৩ করা হয়। তবে বাংলায় যে তিনি ভালো ছিলেন বক্তব্য থেকে বোঝা যায়। রবীন্দ্রসাহিত্য রপ্ত করেছেন সেটার বহিঃপ্রকাশ ঘটে তার শব্দচয়নে।
ছোটবেলায় পরিবার থেকে মানুষ আচার-আচরণ শেখেন। লেখাপড়া শেখেন বিদ্যালয় থেকে। রাষ্ট্রীয় আচার-আচরণ শেখেন রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীদের কাছ থেকে। শিশুকালে পরিবার, বিদ্যালয় এবং প্রতিবেশীর কাছ থেকে যতটুকু শেখা হয়, সেটার প্রতিফলন ঘটে বাকি জীবনে। বড় হওয়ার পর রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডে যোগ দিলেও ছোটবেলায় শিক্ষালাভ করা আচরণের প্রভাব থেকে যায়। এটাই চিরন্তন।
আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বয়সও কম নয়। ষাটোর্ধ্ব বয়সের মুরব্বি। ইতোমধ্যে দাদি-নানি হয়েছেন। নাতি-নাতনির বয়সের সন্তানরা সবাই তার কাছ থেকেই শিখবেন। রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রী কীভাবে কথা বলছেন, মুখের বাচনভঙ্গি কেমন, শব্দচয়ন টেলিভিশনে শুনে শিশুরা অনুকরণ করার চেষ্টা করবে। প্রধানমন্ত্রীর মতো আগামী দিনে বড়মাপের মানুষ হওয়ার স্বপ্ন দেখবে। এটাই তো শিশুদের কাজ। কিন্তু আমাদের প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে কী শিখছে শিশুরা! ৭ মার্চ আওয়ামী লীগের জনসভায় দেয়া ভাষণে উচ্চারিত কতগুলো শব্দ নিয়ে পরিবারের মুরব্বিরা বিপাকে পড়েছেন শিশুদের কাছে।
আমার অতিপরিচিত এক বন্ধুর সাত বছর বয়সের একটি সন্তান রয়েছে। টেলিভিশনের খবরে প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ শুনে বাবার কাছে দৌড়ে আসে। বাবা, বল তো দেখি, ‘দুজনে মিলে কুজনে কী কথা’র মানেটা কী? বাবা জানতে চান কোথায় শুনলে তুমি সেটা? জবাবে সন্তান বলে, ওই যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলতেছে বদু কাকার সঙ্গে নতুন শাড়ি পরে কে জানি বসে ছিল! তারা দুজনে মিলে কুজনে কথা বলেছে। বদু কাকাটা কে? সন্তানের এই প্রশ্নের কী জবাব দেবেন বাবা! রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রী বলেছেন। সন্তান তো এর একটা ব্যাখ্যা চাইতেই পারে।
ইতোমধ্যে পরেরদিন দেখা গেল শেখ হাসিনার বদু কাকা পত্রিকায় প্রতিবাদ পাঠালেন। প্রতিবাদে তিনি কিছু ধর্মীয় বাণী শেখানোর চেষ্টা করলেন। নিজের নামের বাংলা তরজমাটা জানানোর চেষ্টা করলেন প্রতিবাদে। তার নামটা যে আরবি! এটাতে তো সাম্প্রদায়িক গন্ধ রয়েছে। আমাদের প্রধানমন্ত্রী তো আর সাম্প্রদায়িক নন। তিনি তো অসাম্প্রদায়িক লোক। সুতরাং নামের বিকৃত উচ্চারণ করেননি তিনি। বরং অসাম্প্রদায়িক শব্দে রূপ দিয়েছেন নামটির! সেটাই বুঝলেন না প্রধানমন্ত্রীর বদু কাকা।
ডা. এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী সাবেক রাষ্ট্রপতি। প্রবীণ রাজনীতিক তিনি। নাম বিকৃতি করায় তিনি মনে কষ্ট পেয়েছেন। তার প্রতিবাদ থেকে সেটা বোঝা গেছে। কষ্ট পাওয়ারই কথা! এজন্যই হয়তো প্রতিবাদ করেছেন। বলেছেন এটা অশালীন। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী হিসেবে এই নিন্দিত শব্দগুলো ব্যবহার মানায়। তবে প্রধানমন্ত্রীর চেয়ারে বসা কোনো ব্যক্তির মুখে এ ধরনের বক্তব্য বেমানান। তিনি চেয়ারের ইজ্জতের কথা মনে করিয়ে দিলেন। পরিবার থেকে যে যা-ই শিখুন না কেন, রাষ্ট্রীয় চেয়ারের মর্যাদা আলাদা। চেয়ারের মর্যাদা বোঝানোর চেষ্টা করলেন প্রবীণ রাজনীতিক সাবেক রাষ্ট্রপতি।
প্রবীণ রাজনীতিক ডা. এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী ৬ মার্চ দেখা করেছিলেন ১৯ দলীয় জোট নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে। এই সাক্ষাত্ নিয়ে কটাক্ষ করেন ভোটারবিহীন নির্বাচনে বিজয়ী শেখ হাসিনা। অত্যন্ত স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতেই কটাক্ষমূলক শব্দগুলো উচ্চারণ করেছেন তিনি। বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রচর্চা থেকেই হয়তো তার এই শব্দগুলোর আমদানি। তিনি রবীন্দ্রভক্ত। কারণ বাংলাদেশে একটি বিশেষ ধর্মের লোকরাই ‘চাচা’ শব্দটিকে ‘কাকা’ হিসেবে সম্বোধন করেন। তাঁরই প্রতিফলন দেখা যায় রবীন্দ্রসাহিত্যে। আমাদের প্রধানমন্ত্রীরও সেই দিকে বিশেষ দুর্বলতা থাকতে পারে। কারণ অসাম্প্রদায়িক দাবিদার হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্রটির সঙ্গে তার বিশেষ সম্পর্ক রয়েছে।
শেখ হাসিনা শুধু প্রবীণ রাজনীতিক বদরুদ্দোজা চৌধুরীকে নন, সঙ্গে তিনি কটাক্ষ করেছেন তিনবারের প্রধানমন্ত্রী ১৯ দলীয় জোট নেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকেও। শেখ হাসিনার বক্তব্যগুলো হুবহু ছিল এরকম— ‘ছবিতে দেখলাম লাল শাড়ি পরে বদু কাকার সঙ্গে কথা বলছেন। জানি না তিনি রজনীগন্ধা নিয়ে গিয়েছিলেন কি-না। এক সময় তো এমন তাড়া খেয়েছিলেন যে রেললাইনের তলা দিয়ে পালাতে হয়েছিল। তখন তিনি বলেছিলেন, আমি একগুচ্ছ রজনীগন্ধা নিয়ে গেলাম। আজ দেখি দুজনে বসে কুজনে কী কথা বলে।’
সেই ভাষণে প্রধানমন্ত্রী ৫ জানুয়ারির (অবশ্য ভোটারের নীরব প্রত্যাখ্যান হওয়া) নির্বাচনে বিজয়ের রহস্য জানালেন। বললেন—হরতাল, অবরোধ, আন্দোলন চলার পরও আওয়ামী লীগ দক্ষতার সঙ্গে দেশ পরিচালনা করেছে। তাই আবার জয় পেয়েছে। জনগণ নৌকায় আবার ভোট দিয়েছে। কিন্তু শেখ হাসিনা যেটা বলেননি, সেটা হলো—এই ভোটে মানুষ যায়নি। অনেক কেন্দ্রের দরজায় কুকুর শুয়ে থাকার ছবি প্রকাশিত হয়েছে। তিনশ’ আসনের মধ্যে ১৫৩ আসনে মানুষকে ভোট দেয়ার জন্য বলাই হয়নি। বাকি ছিল ১৪৭ আসন। সেখানেও মানুষ যায়নি। তারপরও আওয়ামী লীগ বিজয়ী হয়েছে; সেটা কিন্তু বলেননি প্রধানমন্ত্রী।
আরো যেটা বলা হয়নি ভাষণে, সেটা হলো—বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট যাতে নির্বাচনে না আসে, সুকৌশলে সেই ব্যবস্থা করা হয়েছিল ৫ জানুয়ারি। এজন্য আগে থেকেই এক সময়ে আমার দাবিতে প্রতিষ্ঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমি নিজেই বাতিল করে দিয়েছি; যাতে এটা নিয়ে চেঁচামেচি করতে করতে সময় পার করে দেয় বিএনপি। কারণ নির্বাচনে এলে পরিণতি কী হতো, সেটা উপজেলা নির্বাচনই সাক্ষী। এজন্য বিএনপিকে নির্বাচন থেকে দূরে রাখার যত কৌশল ছিল, সবই নেয়া হয়েছে। এতে কোনো কার্পণ্য করা হয়নি। এ কথাগুলো তিনি বলেননি ৭ মার্চের ভাষণে।
বাংলা সাহিত্যের ছাত্রী শেখ হাসিনা ১৯ দলীয় জোট নেত্রী সম্পর্কে বলতে গিয়ে সাহিত্যের রস ছড়ালেন বক্তব্যে। বললেন, ‘যিনি ১৫ দিন ঘর থেকেই বের হননি, নির্বাচনের আগে ঘন ঘন বিদেশি রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গে বৈঠক করেন, আমাদের নামে নালিশ করেন। নালিশ করে কী পেয়েছেন! নালিশ করে বালিশ পেয়েছেন!’
শেখ হাসিনা সাহিত্যের রসে নালিশ করে বালিশ পাওয়ার কথা বললেও আসল কথাটা বলেননি। নির্বাচনের আগে ১৫ দিন বিরোধীদলীয় নেত্রীকে বাড়ি থেকে বের হওয়ার সুযোগ দেয়া হয়নি। হিন্দুস্তানের প্রতি অনুগত রাষ্ট্রীয় আওয়ামী বাহিনীগুলো ব্যবহার করে বাড়ির গেটে বালুভর্তি ট্রাক রাখা হয়েছে, যাতে বাড়ি থেকে গাড়ি নিয়ে বের হতে না পারেন বিরোধী নেত্রী। পায়ে হেঁটে বের হতে চাইলে তাকে হিন্দুস্তান অনুগত বাহিনীগুলো গেটেই আটকে দিয়েছে। ঘেরাও দিয়ে রেখেছে তার বাড়ি। বাড়িতে কাউকে ঢুকতে দিইনি ১৫ দিন। এটা কিন্তু বলেননি শেখ হাসিনা।
শেখ হাসিনার না বলা কথাগুলোর মধ্যে আরো ছিল, বিরোধী নেত্রীর বাড়ির সামনে যারাই এসেছেন তাদের ধরে নিয়ে গেছে পুলিশ-র্যাব। বাড়ির সামনে এলে কাউকে রেহাই দেয়া হয়নি। বিরোধী নেত্রীর ডাকা মার্চ ফর ডেমোক্রেসি প্রতিহত করতে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে সব যানবাহন বন্ধ করা হয়েছে দেশব্যাপী। দেখামাত্র গুলির নির্দেশ দেয়া হয়েছে রাস্তায়। প্রস্তুত রাখা হয়েছিল আওয়ামী গুণ্ডা বাহিনী। মহিলা গুণ্ডা দিয়ে সুপ্রিমকোর্টে হামলা চালানো হয়েছে। যারাই উঁকি দেয়ার চেষ্টা করেছে, তাদেরই গুণ্ডা বাহিনী ডাণ্ডা দিয়ে ঠাণ্ডা করেছে। এই কথাগুলো কিন্তু বলেননি শেখ হাসিনা। তিনি শুধু বলেছেন নালিশ করে বালিশের কথা।
শেখ হাসিনার ভাষায় বদু কাকার কথা রসিয়ে রসিয়ে বললেন। কিন্তু নিজের আলিঙ্গনের কথা ভুলে গেলেন। এই বদু কাকাদের আলিঙ্গন করার জন্য তার কতই না উদগ্রীব অপেক্ষা ছিল ২০০৬ সালে। এছাড়া আমাদের দেশীয় নারীদের ঐতিহ্য শাড়িকে তিনি কটাক্ষ করলেন। অথচ নিজে তার অতিপ্রিয় হিন্দুস্তানি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলিঙ্গনের জন্য তীর্থের কাকের মতো অপেক্ষায় থাকেন অহর্নিশ।
এই তো সেদিন (৫ মার্চ) বিমসটেক সম্মেলনে মিয়ানমারে গিয়ে কাঙ্ক্ষিত দেখা মেলে দাদাবাবুর সঙ্গে। দুজনে মিলে তখন শুধু কুজনে কথা হয়নি। ছবিতে দেখা যায় হাত ধরে দাদাবাবুর কাছে তিস্তার পানি চেয়েছিলেন; কিন্তু তাও মিলল না। তুমি প্রেম দিয়েছ তবে আজ পানি দিতে পারলাম না আমি। অপেক্ষায় থাকো অনন্তকাল।
লেখক : দৈনিক আমার দেশ-এর বিশেষ প্রতিনিধি, বর্তমানে যুক্তরাজ্যে নির্বাসিত

রবিবার, ৯ মার্চ, ২০১৪

ম্যান্ডেলা নন মুজিবই প্রথম


জানি শিরোনাম দেখেই বলবে, আবারো ফিপফপ! মানলাম। কিন্তু ডিগবাজিতে এরশাদকে অতিক্রম না করা পর্যন্ত আমাকে ডিগবাজ বলা নিষেধ। চিন্তা নেই, এরশাদের সাথে বাজি ধরেছি, জিতলেই জানাবো। কথায় বলে, ‘উচিত কথায় ভাসুর বেজার, তপ্ত ভাতে বেড়াল বেজার।’
বিষয়টি হলো, ১৯৭৪-এর ওআইসি সম্মেলনে যোগ দিয়ে ‘বুচার অব বেঙ্গলদের’ সাথে করমর্দন এবং কোলাকুলির ঘটনা প্রতিষ্ঠিত ইতিহাস হওয়ায় এর একটি ভালো ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। বলছি, ম্যান্ডেলা নন, মুজিবই যুদ্ধাপরাধীদের মার দৃষ্টান্তে প্রথম। সাধারণ মা ঘাঁটতে গিয়ে প্রথমবারের মতো বিষয়টি আমাকে ভাবিয়ে তুলেছে। ভাবছি, এত ব্যতিক্রম হলো কেন? আমার বিশ্বাস, সাধারণ মায় মুজিব যা বলেছেন, কেউই তা অনুসরণ করেননি, বিশেষ করে তার কন্যা। সাধারণ মার বিরুদ্ধে যাওয়ায় মুজিব কতটা প্তি হতেন, সেটাও বিবেচ্য। মুসলমান-ইহুদিতে যুদ্ধ স্বাভাবিক কিন্তু সাধারণ মা না করলে যুদ্ধ হতো তাদের সথে যারা এক ধর্ম, বর্ণ, ভাষা, সংস্কৃতির মানুষ ছাড়াও বিশেষ করে একসাথে স্বাধীন পাকিস্তানের আন্দোলনে। যুদ্ধাপরাধ কেন্দ্র করে একে অপরের বুকে গুলি চালানো শুরু করলে শেষ পর্যন্ত হয়তো একজন বাংলাদেশীও থাকত না। বিষয়টির বিশদ ব্যাখ্যা জরুরি।

সাধারণ মা ও যুদ্ধাপরাধ
১৯৭৩ সালের ৩০ নভেম্বরের সাধারণ মার মর্মার্থ হলো, মুক্তিযুদ্ধে বিরোধিতার জন্য প্রতিশোধ নেবেন না মুজিব, তবে ভুল স্বীকার করে সবাই দেশ গড়ার কাজে নিয়োজিত হবে বলে আশা। তিনি বলেছিলেন, স্বাধীনতার সুফল সবাই ভোগ করুক। ফলে মুক্তি পেলেন খান এ সবুর, খাজা খায়েরউদ্দিন, গভর্নর মালেক, শর্ষীণার পীর, ওয়াহিদুজ্জামান, মাওলানা আবু জাফর, এ কে এম ইউসুফ, আব্বাস আলী খান, শাহ আজিজদের মতো ঘোর পাকিস্তানপন্থীরা। বলেছিলেন, দীর্ঘ সময় বন্দী থেকে আশা করি তোমরা তোমাদের ভুল বুঝতে পেরেছো। অনেকেরই আজীবন জেল হয়েছিল। ৩৫ হাজার ৪৭১টি মামলার মধ্যে ৭৫২টি নিষ্পত্তি হয়। মুক্তি পেলেন ৩৪ হাজার ৬০০ এর বেশি। জেলে থেকেই পরিচিত এবং বন্ধুরা নেতার সাথে যোগাযোগ রাখতেন। শাহ আজিজের পরিবারকে গোপনে নাকি মাসিক তিন হাজার টাকা করে পাঠাতেন। যা ফ্যাক্ট- ১. প্রমাণ সত্ত্বেও খাজা খায়েরউদ্দিনের মতো খুনিদের মুক্তির মাধ্যমে ম্যান্ডেলার আগেই এগিয়ে মুজিব। ২. কাউকে না জানিয়ে দিল্লিতে ১৯৫ জন শীর্ষ ‘বুচার অব বেঙ্গলসহ’ এক লাখ যুদ্ধবন্দীকে মুক্তিদানের মতো বিতর্কিত বিষয়টির নিষ্পত্তি। ৩. ইন্দিরার ঘোর আপত্তি সত্ত্বেও ১৯৭৪ সালে ওআইসি সম্মেলনে গিয়ে ‘বুচার অব বেঙ্গলদের’ সাথে সাধারণ মাকে ইতিবাচক অর্থে কাজে লাগানোর কৌশল। একজন স্বাধীন দেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে এই অধিকার তার ছিল, যেমন ছিল ’৭১-পূর্ব এবং পরবর্তী অবস্থা বিবেচনা করে বিপদের শঙ্কিত হওয়ার সমান অধিকার। খাজা খায়েরউদ্দিন বা টিক্কা খানের মতো খুনি, ধর্ষক, অগ্নিসংযোগকারীদের মুক্তি দেয়ার পরও সাধারণ মার বিধানে একটিমাত্র ব্যতিক্রম রাখা কি তার রাজনৈতিক কৌশল ছিল না? প্রতিটি রাজনীতিবিদেরই নিজস্ব ছক থাকে। আর এটাকেই অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে ডান এবং বাম সুবিধাবাদীরা।
বিষয়টির গঠনমূলক ব্যাখ্যা কিভাবে সম্ভব? যেমনÑ এদের নিয়েই ধর্মের ভিত্তিতে পাকিস্তান আন্দোলন, অন্যথায় জিন্নাহর প্রস্তাব অনুযায়ী কনফেডারেশন স্টেটই দেশবিভাগের বিকল্প ছিল। এরপর একসাথে কখনো রাজপথে, কখনো জেলে, ভাষা আন্দোলন থেকে ছয় দফা এবং লাহোর গোলটেবিলের উদ্দেশ্য একটাই, স্বায়ত্তশাসন। ঐতিহাসিকভাবে সাদা-কালোরা কখনোই একসাথে জাতীয় আন্দোলনে যায়নি কিন্তু ভাষা আন্দোলনে রাজপথে এবং জেলে, মুজিব ও গোলাম আযমদের একটাই দাবি, রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই। এরপর ছয় দফা আন্দোলনেও পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন চাই। অতীতে যে কারণে পাকিস্তান, একইভাবে স্বায়ত্তশাসনেরও দাবি। সমস্যার শুরু, নেহরুর পাতা গর্তে পা, যা আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, হিরোশিমায় বোমা ফেলানোর পেন্টাগন ষড়যন্ত্রের মতো আজো রহস্যজনক। ছয় শর্তে ছয় দফায় পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন ছিল, স্বাধীনতা নয়। সুতরাং এখানে মোটেও প-বিপ ছিল না। তবে নিজামীদের থেকে মুজিবের আদর্শ বিচ্ছিন্ন হওয়ার প্রধান কারণ, স্বায়ত্তশাসন বদলে গেল ‘পাকিস্তান ভাঙো’ আন্দোলনে, যে বিতর্ক এখন ট্রাইব্যুনাল পর্যন্ত গড়িয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের নামে আসলেই কী ঘটতে যাচ্ছিল, এ নিয়ে প্রচণ্ড দ্বিমত ছিল আরেক পরে। তখন ইন্দিরা গান্ধীর উদ্দেশ্য নিয়ে মাও-নিক্সনেরও অভিযোগ, তার উসকানিতেই যুদ্ধ।
২৩৫ বছর আগে নারীবাদী লেখিকা মেরি ওলস্টানক্র্যাফট বলেছেন, ‘মানুষ পরিবেশ এবং পরিস্থিতির শিকার’। আমাদের জন্য উদাহরণ, জিন্নাহ এবং হাসিনা। হাসিনার কথা পরে লিখছি। ১৯১৬ সালে কংগ্রেস এবং মুসলিমের মধ্যে ‘লèৌ প্যাক্ট’ সইয়ের জন্য গোপালকৃষ্ণ গোখলে জিন্নাহর নাম দিলেন ‘হিন্দু-মুসলিম বন্ধনের দূত’। অখণ্ড ভারত রেখে ব্রিটিশ তাড়ানোর কাজে উভয় দলের শিখণ্ডিদের সাথে রাজপথে তখন তরুণ ব্যারিস্টার জিন্নাহ একজন সেকুলার স্টার। আবার এই জিন্নাহই দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত ভাগ না করে একচুল ছাড় দিতে রাজি নন কেন? কারণ ১৯৪৬ সালে দিল্লির ক্যাবিনেট মিটিংয়ে তারই দেয়া কনফেডারেশন স্টেট প্রস্তাবটি নেহরু উড়িয়ে দিলেই দেশ বিভাগের শুরু। বাধ্য হয়ে প্রত্য সংগ্রামের ডাক দিলেন ৩৬০ ডিগ্রি বদলে যাওয়া প্তি জিন্নাহ। ’৪৬-এর প্রত্য সংগ্রাম দিবসের রায়টে দুই বাংলায় কত মানুষ খুন হয়েছিল? এর ফলাফল আনল পাকিস্তানÑ যা বলতে চাইছি, পাকিস্তানিদের শোষণ, নিপীড়ন অব্যাহত থাকলে যথাসময়ে এরাও যে জিন্নাহর মতো বদলে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ত না, গ্যারান্টি কার? পাকিস্তান ভেঙে ভারতের শূন্যস্থান পূরণের বিরুদ্ধে গোলামদের ইউটার্নের যৌক্তিকতার বহু প্রমাণের মধ্যে কয়টা বলব? পদে পদে প্রমাণ, ২৪ বছরে পাকিস্তান যত লুটপাট করেছে, ৪৩ বছরে তার চেয়ে হয়তো বেশি করেছে ভারত। ‘ভারতীয় সেনাবাহিনীর মদদে বাংলাদেশ স্বাধীন করার অর্থ এবং তাৎপর্য বুঝে উঠতে আমার এক মুহূর্তও বিলম্ব হয়নি’ Ñমেজর এম এ জলিল।
১৯৭১-এ না হলে ভবিষ্যতে হতো না কিংবা ভারতকে পাশে না পেলে মুক্তিযুদ্ধই হতো না কিংবা ভারত ছাড়া আরো অর্থবহ যুদ্ধ হতো না, এমন বেদবাক্য কার? ৪৩ বছর পর এ নিয়ে বিতর্কের যথেষ্ট কারণ সৃষ্টি হয়েছে। ইরাক-আফগানে অকুপেশনের ফসল খাচ্ছে মার্কিনিরা। আমি কোনো মনোবিজ্ঞানী নই, কিন্তু সাধারণ মার গদ্য পড়ে যা বুঝি, দেশে ফিরে পচা ইঁদুরের গন্ধ পেয়ে মুজিবই নানান সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছিলেন। ‘মুক্তিযুদ্ধে সহায়তার জন্য ইন্দিরা তাকে সাঁড়াশি চাপে রেখেছিলেন’। তিনিও চাননি বল এক কোর্ট থেকে অন্য কোর্টে যাক। অকুপেশন এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিষয়ে উভয়েরই টানাপড়েন ছিল। তবে সাধারণ মার বদলে তখন যদি পাইকারি হারে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে লিপ্ত হতেন, যতটুকুই করেছিলেন তা-ও পারতেন না। যদি কেউ মনে করে, মুজিব বেঁচে থাকলে বহুদলীয় গণতন্ত্র হতোই না, সারা জীবনই বাকশাল থাকত, মূর্খ তারা। দেশ বিভাগের গতিধারা থেকে বহু শিণীয়।
এ ছাড়া তাজউদ্দীন মন্ত্রিসভায় সিআইএর এজেন্ট মোশতাককে তো তিনিই মন্ত্রিসভায় জায়গা দিলেন। ঠিক একইভাবে পোস্টপার্টাইড দণি আফ্রিকায় বিপরে লোকদের নিয়েই মন্ত্রিসভা। মুজিব হত্যাকাণ্ডের আলোকে বিখ্যাত সাংবাদিক লরেন্স লিপশুলজ ‘অসমাপ্ত বিপ্লব’ গ্রন্থে মুজিবনগর সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোশতাকের ষড়যন্ত্র বিষয়ে লিখেছেন, আমেরিকার কর্মকর্তাদের সাথে আটটি স্থানে গোপন বৈঠকে কিসিঞ্জারের প্রতিনিধিদের সথে অখণ্ড পাকিস্তানের পে সরাসরি আলোচনা হয়। মোশতাক ও পররাষ্ট্রসচিব মাহবুবুল আলমের সাথে আমেরিকার চুক্তি হয় যে, আসন্ন জাতিসঙ্ঘ মিটিংয়ে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব দিলে মোশতাক সেটা মেনে নিলেই মুক্তিসেনারা ফিরে যাবে ব্যারাকে। ’৭১-এর অক্টোবরে সেই মিটিংটি হওয়ার কথা থাকলেও ভারতীয় গোয়েন্দাদের কঠোর নজরদারিতে ষড়যন্ত্র ফাঁস হয়ে গেলে রীতিমতো হইচই। তার বদলে জাতিসঙ্ঘে যান বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর নেতৃত্বে একটি দল। তখন চৌধুরী টিমের বিরুদ্ধে জাতিসঙ্ঘে যারা উপস্থিত তারাই শাহ আজিজের নেতৃত্বে অখণ্ড পাকিস্তানের লবিতে আরেকটি শক্তিশালী দল। এ রকম আরো কয়েকজন যারা থিয়েটার রোডে থেকে গোপনে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করতেন কিন্তু পরবর্তী সময়ে তারা থাকে সরকারে। অর্থাৎ মুজিবের সাধারণ মার ১৭ বছর পর ম্যান্ডেলার মার মডেলে পদে পদে মুজিবের ছায়া। সুতরাং শুরুতেই ভণ্ড কমিউনিস্ট আক্রমণের শিকার না হলে হয়তো সময়মতোই সব কিছু সামাল দিতেন মুজিব।

নেলসন ম্যান্ডেলা
ঐতিহাসিকভাবে ম্যান্ডেলা ও মুজিবের সাধারণ মার মডেল প্রায় হুবহু। গৃহযুদ্ধ এড়াতে দু’জনই প্রোপট অনুযায়ী যা প্রয়োজন করেছেন। এ জন্য দু’জনকেই জনতার কঠোর প্রতিবাদ সহ্য করতে হয়েছে। টিক্কা খানের মতো খুনিদের মুক্তি দিয়ে অন্যদের জন্য ব্যতিক্রমী বিধান রেখে মুজিব তখন নিজেই নিজের সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী। রাস্তায় মুজিববিরোধী মিছিল থেকে মৃত্যু কামনা। তবে খাজা খায়েরউদ্দিন অথবা শাহ আজিজদের মতো যুদ্ধাপরাধীদের মুক্তির রেফারেন্স থাকা সত্ত্বেও এই বিচার কতটা যৌক্তিক, রক্তপাত বন্ধে ট্রাইব্যুনালের বিচারকদের বিবেকপ্রসূত দায়িত্ব অপরিসীম হওয়ার কারণ, প্রতিটি রায়ের পরেই এত রক্তপাত গ্রহণযোগ্য নয়। আমরা শান্তিতে থাকতে চাই, স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি চাই। এখানেই মুজিব-ম্যান্ডেলার সাধারণ মার বাস্তবতা। ম্যান্ডেলা যখন বাংলাদেশে, তখন বহুদলীয় গণতন্ত্র জমজমাট। উন্নয়নে সবার অংশগ্রহণ জমজমাটÑ যা বলতে চাইছি, ৩৬০ ডিগ্রি বদলে যাওয়ার কিছু উদাহরণ। যেমনÑ রাজনৈতিক আন্দোলন থেকে পার্লামেন্ট, নিজামী, গোলাম আযমদের সাথে আওয়ামী সভানেত্রীর খুব ভালো সম্পর্ক। নিজামীদের সাথে চা-চক্র, অর্থাৎ বহুদলীয় গণতন্ত্রের সুখাদ্য খেয়েছেন হাসিনাই বেশি এবং সেটাই ভালো। স্বাধীনতাবিরোধী খুনি এরশাদকে টেনে নামিয়ে তার সাথেই মহাজোট। অভ্যুত্থানের জন্য মাইনু-ফখরুকে পুরস্কৃত করে দিনরাত জিয়াউর রহমানকে দোষারোপ। এমনকি ২০০৭ সালে খেলাফতে মজলিসের সাথে ফতোয়ার চুক্তি, যার অন্যতম ‘ব্লাসফেমি’ আইন। বর্তমানে এই মনমানসিকতার উগ্রপন্থীদের বিরুদ্ধেই তো সন্ত্রাসের অভিযোগে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন শেখ হাসিনা। আওয়ামী লীগের সর্বোচ্চপর্যায়ে বারবার মন পরিবর্তনের সাথে, ...পরিবেশ এবং পরিস্থিতির কারণে ’৭১-এর অভিযুক্তদেরও ৩৬০ ডিগ্রি বদলে যাওয়ার একটি প্যারালাল খুঁজে পাওয়া যায়। সরকার অভিযুক্তদের সাধারণ মার বিষয়টি অস্বীকার করতেই পারেন কিন্তু তাতে সাধারণ মারই মর্যাদা ুণœ হবে। মুজিব বেঁচে থাকলে এ ধরনের পরিস্থিতি সহ্য করতেন কি না বলা মুশকিল। এ জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী ঘাদানিক। সাধারণ মা অমান্য করতে সরকারকে বেশি বিভ্রান্ত করল এরাই। কিন্তু আমার স্কুল অব অ্যাক্টিভিজমে, যে বিষয়টি কখনোই আমার কাছে বোধগম্য নয় এবং জীবন থাকতে হবেও না, তা হলো, মুক্তিযুদ্ধের একজন ব্রিলিয়ান্ট সেক্টর কমান্ডার, মঞ্জুরের মতো একজন বীর উত্তম মেজর জেনারেলকে খুনের দায়ে অভিযুক্ত কাঠগড়ার আসামি এরশাদকে কোন যুক্তিতে বিশেষ দূত করা? এটাই কি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা? এটা যদি মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী না হয়, কলঙ্ক না হয়... ’৭১-এর বিরোধীদের বিচারের যোগ্যতা কার? সাধারণ মা মেনে নিলে বিশ্বের কাছে কখনোই এত সমালোচিত হতো না বাংলাদেশ।
ধর্মভিত্তিক রাজনীতি ভালো না মন্দ সেই বিতর্কে যাচ্ছি না তবে বাস্তবতা হলো দেশ বিভাগ আর মুক্তিযুদ্ধ পরস্পরবিরোধী কামানের মতো, দুটোই এক কারিগরের তৈরি। পাকিস্তান অর্জন করতে গিয়ে হিন্দু-মুসলমানের গণহত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, হলোকাস্টের চেয়ে ভয়াবহ। এ জন্য ’৪০ সাল থেকে যত রক্তগঙ্গা পৃথিবীতে আর কোনো দেশ ভোগ করেনি। আমার বিশ্বাস, নেহরুর পাতা ফাঁদে পা না দিলে হয়তো স্বায়ত্তশাসনেই সীমাবদ্ধ থাকতেন মুজিব এবং ভারত ছাড়াই মুক্তিযুদ্ধ হতো। আমরাও ছোট উপনিবেশের হাত থেকে বড় উপনিবেশবাদীদের হাতে কখনোই পড়তাম না। আজ প্রশ্ন উঠেছে, দেশ বিভাগ কি ভুল ছিল? সাধারণ মা নিয়ে রাজনীতি করলে সামনে অনেক কিছুই ভুল মনে হবে।
সাধারণ মা ঘোষণার সাথে সাথে মুজিববিরোধী বিােভে ফেটে পড়েছিল শহীদ পরিবারগুলো। আর এ পরিপ্রেেিতই ঘাদানিকের মতো তৃতীয় শ্রেণীর বামদের আত্মপ্রকাশ। প-বিপ সৃষ্টি করে গৃহযুদ্ধ বাধানোর প্রথম কাজটা করল রায়বল্লভদের নতুন দুর্গÑ ঘাদানিক। পরবর্তী সময়ে বিচারের সাথে যুক্ত হলো মতা, শরিক হলেন হাসিনা। যার যা কৃতিত্ব, দিতেই হবে। মুজিবের ছিল না হলিউড, ওয়াশিংটন, ম্যানহাটনের বড় বড় নেতা, লবিস্ট, অ্যাক্টিভিস্ট। ম্যান্ডেলার ছিল বিশপ ডেসমন্ড টুটু, নিউ ইয়র্কের মেয়র ডিনকিন্স, বক্সার মোহাম্মদ আলী, হলিউডের স্পাইকলির মতো স্বনামধন্য ব্যক্তিত্ব। নিউ ইয়র্কের মেয়র ডিনকিন্স অভূতপূর্ব প্যারেড দিলে সেখান থেকেই নোবেলের দাবি। ম্যান্ডেলার ভাগ্যে নোবেল, এদের কারণেই মুজিবের কপালে বিতর্কের দায়িত্ব আওয়ামী লীগ কি এড়াতে পারে?

৯ম পার্লামেন্টে কমিউনিস্ট আগ্রাসন ও বিচার
সোস্যালিজম আর কমিউনিজম দুটোই বিষ। সংবিধানে গণতন্ত্রের মধ্যে সমাজতন্ত্রের কাবাব বানিয়ে রোগীর সর্বনাশ। তবে সো কলড কমিউনিস্টদের খপ্পরে না পড়ে সাধারণ মার বিষয়টি আমলে নিলে, দুটো কাজ হতো, ১. মুজিবকে আর বিতর্কিত না করা, ২. দেশরা। কিন্তু মুজিবের মতোই তারও ভাগ্যাকাশে সিদুঁরে মেঘ। সংসদ এবং বাইরে তাকেও ঘিরে ফেলেছে বামপন্থীরা। কমিউনিস্ট অভ্যুত্থানের ফসল ১৫ আগস্ট, এবার খালেদাকে মাইনাস করে নতুন ষড়যন্ত্র। অতীতে মুজিবকে হুমকির মতো টকশোতে বসে খালেদাকে গুলি করার হুমকি দিলেন বাদল। ঘরে ঘরে ঢুকে হত্যাযজ্ঞ চালাতে চান লতিফ সিদ্দিকী। মন্ত্রী কামরুলের দাবি বিএনপি হলো সন্ত্রাসের দল। তোফায়েলের দৃঢ়বিশ্বাস, খালেদাকে পাকিস্তান পাঠিয়েই ছাড়বেন। প্রধানমন্ত্রী কী বলেন, না-ই বা বললাম। যা বলতে চাইছি, কমিউনিস্ট মানেই লাল পতাকা নয় বরং মুজিব কোটের তলে কিংবা বাইরে নানান প্রজাতির ভণ্ড বামপন্থী এরা, ইতিহাস বলে, বাঙালিদের ধ্বংসের জন্য বাইরের কারো লাগে না ভেতরের শত্র“ই যথেষ্ট।
ট্রাইব্যুনালকে কেন্দ্র করে যা হচ্ছে, মুজিব বেঁচে থাকলে কতটা প্তি হতেন জানি না, তবে এই দফায় কমিউনিস্টদের ভাগ্য ভালো। অতীতে এদের বিরুদ্ধেই মুজিবের জিরো টলারেন্স, ‘কোথায় সিরাজ শিকদার’ মুজিবের বিখ্যাত উচ্চারণ। ৪০ বছর পর আবারো কমিউনিস্টদের কারণে গৃহযুদ্ধের অবস্থা। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হোক, সব ক’টির ফাঁসি হোক, আমিও চাই কিন্তু বিচার হবে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত এবং সন্দেহাতীত। কিন্তু যেভাবে ফাঁসি চেয়ে বিশ্বরেকর্ড করা হচ্ছে, বিচার নিরপে হবে কোন দুঃখে? বিচার প্রভাবিত করতে যা যা লাগে, বেশিই করছে সরকার এবং তার কমিউনিস্টরা যার সবচেয়ে বড় প্রমাণ স্কাইপ কেলেঙ্কারি। ট্রাইব্যুনালের একজন সিটিং বিচারক যখন বাইরের কারো সাথে চলমান মামলা নিয়ে আলোচনা করেন, আন্তর্জাতিক আইনে বেআইনিই নয় পুরোটাই মিস ট্রায়াল। এই রেফারেন্স পশ্চিমের বহু বড় বড় মামলা থেকে নেয়া যেতে পারে। ব্যতিক্রমের কারণ, আওয়ামী মেনুফেস্টোতে যুদ্ধাপরাধীদের বিষয়টি হয়ে গেল শৌখিন লাল পতাকাওয়ালাদের ‘কমিউনিস্ট মেনুফেস্টো’। এটাকেই ক্যাশ করে মতিয়ারা প্রথমেই সাধারণ মার বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামেন। দিনে সাম্যবাদ রাতে কূটনীতিপাড়া। এই দাগে বিষের প্রভাব এত বেশি যে, মানুষের সন্দেহ, সত্যিই এসব হাসিনার কাজ কি না!
স্বাধীনতার শুরুতেই পাকিস্তান আমলে নিষিদ্ধ বামদের আত্মপ্রকাশ ও অত্যাচার। যেখানে সোস্যালিজম আর কমিউনিজম সেখানেই জাদুঘরে মানবাধিকার। আমরা তাদেরই বন্দুকের নলে। ’৭২ থেকে ’৭৫-এর নৈরাজ্য নিশ্চয়ই ভুলে যায়নি আওয়ামী লীগ। হাসিনা জানেন, অন্য কেউ নন বরং জাতীয় সরকার প্রশ্নে বনিবনা না হওয়ার উত্তেজনা থেকেই মুজিবের বিরুদ্ধে এক তাত্ত্বিক নেতা এবং যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধার মস্তিষ্কে নিষিক্ত হয় মুজিব হত্যার প্রথম ভ্রƒণ। আমার ধারণা এই দাগে বৈদেশিক কমিউনিস্ট শক্তি পরিচালিত বামদের নীলনকশাটি আরো বড়। এদেরই কুপ্রভাবে একটি কাজও সুস্থমতো করতে পারেননি হাসিনা, যার অন্যতম প্রমাণ পদ্মা সেতুর মৃত্যু এবং প্রতিটি রায়ের পরেই খুনোখুনি। লাশ ফেলা যেন পচা তরকারির চেয়ে সস্তা। এদের কারণেই বিচার কেন্দ্র করে ’৭১ পূর্ববর্তী অবস্থা। স্বামী-স্ত্রী যখন একে অপরের শত্র“, একমাত্র সমাধান ডিভোর্স। কিন্তু ১৬ কোটি মানুষের জন্য দু’টি কনফেডারেশন বাংলাদেশে কি সম্ভব? সেই অর্থে মুজিব, ম্যান্ডেলাই বাস্তব রাজনীতিবিদ। আমরা পড়েছি অ্যামেচারদের খপ্পরে। যাদের ওয়ার্ড কমিশনার হওয়ার যোগ্যতা নেই, এক পয়সার অরজ্ঞান নিয়ে এমন অনেকেই পার্লামেন্টেরিয়ান। ভিসি যখন ছাত্রকে দেখলে স্যার স্যার বলে চেয়ার ছেড়ে দেন, ব্যাখ্যার প্রয়োজন আছে কি?
সর্বহারা, গণবাহিনী, জাসদ... মুজিববাদীদের দাবি সন্ত্রাস নির্মূল করতেই বাকশাল আর রীবাহিনী। পাইকারি জেল আর ক্রসফায়ারে হত্যার ইতিহাস মতিয়াদের জানা। মুখে গণতন্ত্র, কাজে বন্দুক, দেশটাকে ল ভ  করার জন্য দায়ী চীন আর রুশপন্থীরা। গৃহযুদ্ধের আগুনে পুড়িয়ে মারতে ‘গণমঞ্চ’ নামের আরেকটি দুষ্ট ব্লকের সৃষ্টি করল ভারত এবং চায়নাপন্থীরা। এরা বিশ্বাস করে মিলিটারিইজমে। কমিউনিস্ট পরিবেষ্টিত হাসিনা যখন সন্ত্রাসের কথা বলেন, সত্যিই হাসি পায়। শাহবাগে সন্ত্রাসী অভ্যুত্থানে সরাসরি পৃষ্ঠপোষকতা দিলো ভারত এবং সরকার, যা চাইলেও অস্বীকার করা যাবে না। এসবের মূলে ৪০ বছর পর এবার ডান-বামের জগাখিচুড়ি, সাধারণ মাকে যারা গলা টিপে হত্যা করল।

যা হতে পারত
হোমওয়ার্ক করলে যা হতো। এত দিনে পদ্মা সেতুর ফসলও ঘরে তোলা যেত। গার্মেন্ট নামের শ্রেণী বৈষম্যের জাহান্নামতুল্য শিল্পের প্রতিস্থাপনে মধ্য শ্রেণীর শিল্পের দিকে এগোনো যেত। হাজার হাজার কোটি টাকার জ্বালানি তেলের দুর্নীতিশ্রেষ্ঠ ব্যবসায় বাদ দিয়ে জার্মানির মতো সোলার প্ল্যান্টে বিদ্যুৎ স্বয়ংসম্পূর্ণতার দিকে যাওয়া যেত। হলমার্ক, শেয়ারবাজারের মতো অবৈধ সন্তানগুলোকে ভ্রƒণেই গর্ভপাত করানো যেত। সম্ভাবনাময় ৫০ বিলিয়ন ডলারের পর্যটন খাতকে প্রাধান্য দিয়ে আধুনিক কৃতদাসপ্রথা নিভিয়ে দেয়া যেত। সমুদ্র বিজয়ের সব ফসল তাঁবেদারদের পকেটে তুলে না দিয়ে বরং দেশের ভেতরেই দু-একটি সহযোগী প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি করা যেত। সমস্যা হলো বামদের খপ্পরে পড়া হাসিনার সময় কোথায়! যা বলছি, বামদের কমিউনিস্ট মেনুফেস্টো গ্রহণ এবং মুজিবের সাধারণ মা ঘ্যাচাং করার মাধ্যমে বিশ্বজুড়ে বাংলাদেশকে কলঙ্কিত করা ছাড়া কাজ আর যা হলো, প্রয়োজনের তুলনায় অতি নগণ্য। অর্থাৎ গেরস্থের মুরগি তো ডিম পাড়বেই কিন্তু তাই বলে মুরগির প্রতিটি ডিম কি ঘরে ঘরে গিয়ে দেখাতে হবে? তাহলে গেরস্থের মুরগি পালার দরকারটা কী?
ফলে এক কাঁধে ট্রাইব্যুনাল, অন্য কাঁধে কমিউনিস্ট নিয়ে লেজেগোবরে গাড়ি আর চলছেই না। ডিজিটাল ট্রেনের এনালগ ইঞ্জিন অবাস্তব। পাঁচ বছরে যে পরিমাণ শক্তি ও অর্থ য় করলেন, এক সহস্রাংশও করলে একটি মানুষকেও ক্রসফায়ারে মারতে হতো না। ইউনূসকে ধরে টানাটানি না করলে, দু’টি পদ্মা সেতু সম্ভব হতো। সাদা লক্ষ্মী পায়ে ঠেলে এখন রিজার্ভ ধরে টানাটানি। খেতে খেতে শেষ, এবার শেয়ারমার্কেট আর পদ্মা সেতুর সর্বভুকেরা রিজার্ভ খেয়ে শেষ না করে নড়বে না। আমাদের অনুজ দণি আফ্রিকার মাথাপিছু আয় ১১ হাজার ডলারেরও বেশি। ১৪ শ’ শতাব্দীর কৃতদাস প্রথার মতো উল্টো আমরাই এখন বাংলাদেশ থেকে আফ্রিকাতে ২১ শ’ শতাব্দী ভার্সনের আধুনিক কৃতদাস পাঠাই, এরাই প্রবাসী শ্রমিক। যা বলছি, ট্রাইব্যুনালকে কেন্দ্র করে আফ্রিকায় গৃহযুদ্ধ হলে তিগ্রস্ত হবে ৫৪ মিলিয়ন, যা বাংলাদেশের বেলায় ১৬৫ মিলিয়ন। সময় থাকতে ভাবুন ঠাণ্ডা মাথায়।

সমাজতন্ত্রের বিপদ
একটি ঐতিহাসিক প্রোপট স্মরণে থাকা মঙ্গলজনক। সংবিধানে একই সাথে সমাজতন্ত্র ও গণতন্ত্র মানে প্রজাতন্ত্রের কাবাব। শুরুতেই সমাজতন্ত্রের দিকে মুজিবের ঝোঁক পছন্দ করেনি পশ্চিমারা। কিউবার সথে বাণিজ্যে আমেরিকার ঘোর আপত্তি। ’৭৪-এর দুর্ভিরে সময়ে মধ্য সমুদ্রে তখন খাদ্য জাহাজ, নিক্সন প্রশাসনের প থেকে বলা হলো, কিউবার সাথে বাণিজ্য বন্ধ করতে হবে (পাটজাতীয় পণ্যগুলো যাচ্ছিল কিউবায়)। সেটা না হওয়ায় ফিরিয়ে নিলো খাদ্য জাহাজ। পরের ইতিহাস জানলেও কোনো শিা নিইনি। ’৭১কে কেন্দ্র করে বদলেছে পুঁজিবাদীদের দৃষ্টিভঙ্গি। এবারো পশ্চিমের সাথে সম্পর্ক অবনতি করে কমিউনিস্টদের সাথে সম্পর্ক গড়ার প্রবণতা উদ্বেগজনক। পশ্চিমারা কোনো কিছুই খুলে বলে না বরং ঘুরিয়ে বলে। ‘আলেন্দে’ হত্যার আগে তার সবচেয়ে ভালো বন্ধু ছিল একটি এলিটগোষ্ঠী যাদের বেশির ভাগই ‘সিআইএ’। ’৭২Ñ৭৫, ভালো এবং মন্দ মুজিবের জীবন থেকে দুটোই শিণীয়। কমিউনিস্ট না সোস্যালিস্ট আমি নিজেও বিভ্রান্ত, মইনুদ্দিন খান বাদলরা এবার মোশতাকের ভূমিকায় কি না... অতীতের মতো হাসিনার ঘরেও আগুন দিলো। নোবেলপ্রাপ্ত লেখক নাইপল তার বিখ্যাত উপন্যাস, ‘বেন ইন দ্য রিভার’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘ঘটনার কাছাকাছি থাকলে দেখা যায় না’। হাসিনাও বামদের বাইরে কিছুই দেখছেন না। ৪০ বছর পর এমন কিছুই ঘটেনি, যে জন্য টিক্কা খানের মতো ‘বুচার অব বেঙ্গল’কে মুক্তি দিয়ে টমের বিচার কিংবা খাজা খায়েরউদ্দিনের মতো ধর্ষক এবং অগ্নিসংযোগকারীকে ছেড়ে দিয়ে হ্যারির ফাঁসি। (বিষয়টি আদালতের দৃষ্টি আকর্ষণযোগ্য)। আরেক কমিউনিস্ট লন্ডন প্রবাসী কলামিস্ট ক্রমাগত হাসিনাকে বিভ্রান্ত করে চলেছেন। ৮০ বছরের বৃদ্ধ যখন বয়সে ছোট কারো পায়ে ধরে আকুতি মিনতি জানিয়ে রাজনৈতিক খুতবা দেন বেহায়াপনাই নয়, লজ্জাজনকও। এভাবেই কমিউনিস্টদের খপ্পরে পড়ে অগ্ন্যুৎপাতের মুখে বাংলাদেশ।
তার পরও বিচার যদি করতেই হয় করুন, কিন্তু কখনোই সেটা এইপর্যায়ে নয় যখন লন্ডনের ‘আফতাব পার্ক’ কিংবা নিউ ইয়র্কের ‘জ্যাকসন হাইটসের’ রাস্তায় বিদেশীদের সামনে বিভক্ত বাংলাদেশীরা মুজিব-জিয়ার নামে চিৎকার করে স্লেøাগান দিতে দিতে ডাণ্ডাপেটা করবে আর পুলিশ এসে হাতকড়া পরাবে, তখন বিদেশীরা অবাক চোখে বলতে থাকবেÑ শেইম অন ইউ বাংলাদেশ! গো ব্যাক ইউর কান্ট্রি ইউ ডার্টি ম্যান (দ্রষ্টব্য : আফতাব পার্কে গণ্ডগোলের ভিডিও)।

উপসংহার
’৭২-এ মুজিবের সাথে মতা নিয়ে দ্বিমত হওয়ায় ‘কমিউনিস্টদের’ নৈরাজ্য এবং সাধারণ মাকে কেন্দ্র করে ঘাদানি ধরনের ‘সোস্যালিস্টদের’ আত্মপ্রকাশই ১৫ আগস্টসহ সব অভ্যুত্থানের বীজ। সুস্থ বাংলাদেশ চাইলে লাল-নীল-সবুজ সব ধরনের বাম বিষমুক্ত রাজনীতির বিকল্প নেই। এই দাগে ভয়ঙ্কর বেপরোয়া বামপন্থীরা, মুজিব এবং তার কন্যা বরাবরই এদের খপ্পরে পড়ে ভুগছেন এবং ভোগাচ্ছেন, যে মতা ভোটাররা কাউকেই দেয় না। প্রতিযোগিতা হওয়া উচিত দেশটাকে কে কত বেশি ভালোবেসে এগিয়ে নিতে পারে। তাই ম্যান্ডেলার মতো মুজিবের সাধারণ মাকেও সমান গুরুত্ব দিয়ে দেখার সময় ফুরিয়ে যাচ্ছে। ‘স্বাধীনতার জন্য যারা যুদ্ধ করে, আমেরিকার চোখে তারা টেরোরিস্ট’। Ñনোয়াম চমেস্কি।
দ্রষ্টব্য : লেখাটি অ্যাক্টিভিজমের ভিত্তিতে
নিউ ইয়র্ক প্রবাসী//collect from naya diganta
মিনা ফারাহ
farahmina@gmail.com

মালয়েশিয়ার নিখোঁজ বিমানের খোঁজে ২২ বিমান ও ৪০ জাহাজ

মালয়েশিয়ার নিখোঁজ বিমানের খোঁজে ২২ বিমান ও ৪০ জাহাজ