সোমবার, ২৩ জুন, ২০১৪

জিয়া বাংলাদেশের প্রথম প্রেসিডেন্ট ও মুজিব ব্যর্থ পলিটিশিয়ান

ওয়ার্ল্ড কাপ ফুটবল ২০১৪ টুর্নামেন্টের ওপেনিং ম্যাচে সাও পাওলোতে ব্রাজিল একটি বিতর্কিত পেনালটির সাহায্যে ৩-১ গোলে ক্রোয়েশিয়ার বিরুদ্ধে বিজয়ী হয়েছে। ইতিপূর্বে ব্রাজিল পাচবার চ্যাম্পিয়ন হলেও অনেকের মতে এই ম্যাচে ব্রাজিলিয়ান ফুটবল ছিল অনাকর্ষনীয়। তারা বলেন, এভাবে খেললে ব্রাজিল এবার চ্যাম্পিয়ন হবে না। টুর্নামেন্টের দ্বিতীয় দিনে গত ওয়ার্ল্ড কাপ চ্যাম্পিয়ন স্পেনও একটি বিতর্কিত পেনালটির মাধ্যমে হল্যান্ডের বিরুদ্ধে এগিয়ে যায়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত হল্যান্ড ৫-১ গোলে বিজয়ী হয়। অনেকের মতে হল্যান্ড এই ম্যাচে আরো তিনটি নিশ্চিত গোলের সুযোগ নষ্ট করেছে। স্পেনের এই শোচনীয় পরাজয় এবং হল্যান্ডের দুর্দান্ত নৈপুন্য ওয়ার্ল্ড কাপে প্রতিযোগী বাদবাকি ৩০টি দেশের কাছে অশনি সংকেত পাঠিয়েছে। এখন বিশ্ব জুড়ে ফুটবল প্রেমীদের মনে একটা প্রশ্ন, দুই ফেভারিটের (ইংরেজি শব্দ ঋধাড়ঁৎরঃব-এর উচ্চারন ও বাংলা বানান ফেভারিট - ফেবারিট নয়) যদি এই অপ্রত্যাশিত দুর্বল অবস্থান হয়, তাহলে এবার ওয়ার্ল্ড কাপ ফুটবল চ্যাম্পিয়ন কোন দেশটি হবে? এই একটি প্রশ্ন যখন স্টেডিয়াম থেকে ফাস্ট ফুড শপে এবং বাড়ি থেকে অফিসে, সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত হচ্ছে, তখন ব্রাজিল থেকে প্রায় দশ হাজার মাইল দূরে বাংলাদেশে রাজনীতি প্রেমীদের মুখে উচ্চারিত হচ্ছে অন্য আরেকটি প্রশ্ন।
সেটি হলো কেন প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের বড় ছেলে, বিএনপির সিনিয়র ভাইস-চেয়ারম্যান, বর্তমানে লন্ডনে বসবাসরত ও চিকিৎসাধীন তারেক রহমান গত মার্চ থেকে প্রয়াত রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের কর্মকান্ডের মুল্যায়ন করে চলেছেন?
কেন? কেন? কেন?
রাউন্ড ওয়ান
স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে পুর্ব লন্ডনের রয়াল রিজেন্সি মিলনায়তনে মঙ্গলবার ১৮ মার্চ ২০১৪-তে “বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি ও স্বাধীনতার ঘোষক জিয়া” শীর্ষক এক আলোচনা সভায় ৮ মার্চ ১৯৭১-এর দৈনিক ইত্তেফকের সংবাদ শিরোনাম উদ্ধৃত করে তারেক রহমান বলেন, “৭ মার্চের ভাষণে ছয় দফা বাস্তবায়নের জন্য হরতাল আহ্বানের কোনো ঘোষনা ছিল না। ... ২৬ মার্চ জিয়াউর রহমানই স্বাধীনতার ঘোষনা দিয়েছিলেন। তিনিই বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি। মুজিবনগর সরকার গঠিত হয়েছিল পরে এপৃলে। স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন তৎকালীন মেজর জিয়াউর রহমান। এই স্বাধীনতার ঘোষণাটি তিনি নিজের হাতে লিখেছিলেন। ... শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন বাংলাদেশের প্রথম অবৈধ প্রধানমন্ত্রী ... শেখ মুজিবুর রহমান ১০ জানুয়ারি ১৯৭২-এ পাকিস্তানের পাসপোর্ট নিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের অপমান করেন।”
তারেক রহমানের এই ভাষনের পরে বাংলাদেশে আওয়ামী মহলে তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়। আওয়ামী স্পোকসপারসন রূপ যারা পরিচিত তারা তাৎক্ষনিকভাবে, মুর্খ, আহাম্মক, অর্বাচীন বালক, বেয়াদব, প্রভৃতি বিশেষনে তারেককে ভূষিত করেন। এই পর্যায়ে শেখ হাসিনা কোনো মন্তব্য থেকে বিরত থাকেন।
রাউন্ড টু
এই প্রতিক্রিয়ার রেশ মিলিয়ে যেতে না যেতেই জিয়াউর রহমানের ৩৩তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে লন্ডনের উপকন্ঠে ইলফোর্ডে আয়োজিত এক আলোচনা সভায় বুধবার ২৮ মে ২০১৪-তো তারেক বলেন, “শেখ মুজিব ৩০ বছর রাজনীতি করার পরেও রাজনীতিক হিসেবে ছিলেন ব্যর্থ। অন্য দিকে জিয়া সেনাবাহিনী থেকে রাজনীতিতে এসে মাত্র পাচ বছর রাজনীতি করে সফল রাজনীতিক ছিলেন।... শেখ মুজিব (১) গণতন্ত্রের কথা বলে আওয়ামী লীগ বিলুপ্ত করে বাকশাল গঠনের মাধ্যমে এক দলীয় শাসন চালু করেছিলেন (২) জনগণের নিরাপত্তা বিধানের কথা বলে গুম-খুনের বিস্তার ঘটিয়ে এবং বিরোধী দল দমনের জন্য রক্ষীবাহিনী গঠন করে আতঙ্কের জনপদ তৈরি করেছিলেন এবং (৩) অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির কথা বলে দুর্ভিক্ষ তৈরি করেছিলেন। ... জিয়া দেশে বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন এবং অর্থনীতিকে দৃঢ় বুনিয়াদের ওপর দাড় করান।”
লক্ষনীয় যে তারেক এক দিকে শেখ মুজিবের নিন্দনীয় দুর্বলতা, ত্রুটি ও ব্যর্থতাগুলো বলার পাশাপাশি অন্য দিকে জিয়ার প্রশংসনীয় সাহসিকতা, গুনাবলি ও সাফল্যের কথা তুলে ধরেন।
তারেকের এই দ্বিতীয় ভাষণের পর আওয়ামী মহলে প্রতিক্রিয়া আরো তীব্র হয়। আওয়ামী নিয়ন্ত্রিত দেশের টিভি মিডিয়াগুলোতে ক্রুদ্ধ স্বরে আওয়ামী অভিভাবকরা বিরতিহীন বক্তব্য রাখতে থাকেন। মানসিক ভারসাম্যহীন, উম্মাদ, পাগল, বাচাল, প্রভৃতি আরো কিছু নতুন বিশেষন তারা প্রয়োগ করেন তারেক রহমানের নামের আগে। কিন্তু তারা কেউই আগেও যেমন তারেকের তথ্য ও যুক্তি খন্ডন করার সামান্য চেষ্টা করেননি - এবারও তারা তাদের প্রতিক্রিয়া তারেককে গালিগালাজের মধ্যেই আবদ্ধ রাখেন।
এই পর্যায়ে আরেক প্রয়াত রাষ্ট্রপতির সন্তান শেখ হাসিনা ড্যামেজ কনট্রোল ও লিমিটেশনের জন্য বিতর্কে যোগ দেন।
সোমবার ২ জুন ২০১৪-তে গণভবনে আওয়ামী লীগের যৌথসভার সূচনা বক্তব্যে শেখ হাসিনা বলেন, “জিয়াউর রহমান মরে গিয়ে বেচে গিয়েছেন। নতুবা ওকেও (জিয়াকে) বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার আসামি করতাম। ... বঙ্গবন্ধুর খুনি মোশতাক। আর মোশতাকের পছন্দ ছিল জিয়া। ... হত্যা, ক্যু ও ষড়যন্ত্রের মূল হোতা ছিল জিয়া।”
লক্ষনীয় যে আওয়ামী নেতা ও অভিভাবকরা সকল কটু কথা তারেকের প্রতি প্রয়োগ করলেও জিয়াউর রহমানের চরিত্র হননে এগোননি। কিন্তু শেখ হাসিনা করলেন বিপরীতটা। তিনি তারেকের প্রতি গালি উদগার না করে, জিয়াউর রহমানের প্রতি করলেন, যা তিনি আগেও করেছেন। সম্ভবত শেখ হাসিনার কোনো প্রটোকল অফিসার উপদেশ দিয়েছিলেন, নেত্রী, পোলাকে এটাক করাটা হয়ে যাবে আপনার লেভেলের নিচে। সুতরাং পোলাকে এটাক না করে পোলার বাপকে এটাক করুন।
কিন্তু এই প্রক্রিয়াতে শেখ হাসিনা এসে ঠেকেছেন, বয়সে এবং রাজনীতিতে তার চাইতে অনেক জুনিয়র, তারেকের লেভেলে। কারণ দুজনাই তাদের প্রয়াত পিতার সুনাম রক্ষার জন্য কথা বলছেন। তবে তারেক তার প্রতিপক্ষের পিতার দুর্নাম এবং নিজের পিতার সুনামগুলো সুনির্দিষ্টভাবে করেছেন - যেটা শেখ হাসিনা তার বক্তব্যে পারেননি।
তিনি খুব দুর্বলভাবে নিজের পিতার হত্যাকান্ডে জিয়ার সম্পৃক্ততা দাড় করাতে চাইলেও তার পিতার কোনো সুনাম প্রতিষ্ঠা করতে পারেননি।
রাউন্ড থৃ
ওয়ার্ল্ড কাপ ফুটবল টুর্নামেন্টের মতোই এই পলিটিকাল টুর্নামেন্টের লোকেশন এরপর বদলে যায়। ফ্রম লন্ডন টু কুয়ালা লামপুর। বৃহস্পতিবার ১২ জুন ২০১৪-তে কুয়ালা লামপুরে স্থানীয় বিএনপি শাখা আয়োজিত এক আলোচনা সভায় তারেক তার টার্গেট বদলে ফেলেন। তারেক যখন লন্ডনে শেখ হাসিনার পিতাকে টার্গেট করেছিলেন তখন ঢাকায় শেখ হাসিনা টার্গেট করেন তারেকের পিতাকে। এবার কুয়ালা লামপুরে তারেক টার্গেট করেন শেখ হাসিনাকেই।
বাংলাভিশন টিভিতে আংশিকভাবে প্রচারিত খবরে দেখা যায়, তারেক বলেন (১) “তুমি দেশে ফেরার ১৭ দিন পরেই কেন জিয়া খুন হলেন? তুমি যদি কিছু না জানবে, তাহলে বোরকা পরে পালাচ্ছিলে কেন?” (২) “২০০৯-এ ক্ষমতায় আসার পরপরই বিডিআরের ৫৭ জন অফিসার নিহত হলো কেন? ডিফেন্স মিনিস্টার তো তখন হাসিনাই ছিল। এই হত্যাকান্ডের জন্য তার ৫৭ বার ফাসি হতে পারে। (৩) হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলার সংরক্ষিত সাতছড়ির গহিন বনে সাতটি বাংকার ও বিপুল পরিমাণ আগ্নেয়াস্ত্রের সন্ধান পেয়েছে র‌্যাব। অতীতে চট্টগ্রামে অস্ত্র চোরাচালান ধরা পড়ার পর তদানীন্তন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ও শিল্পমন্ত্রীকে যদি ফাসির দন্ড দেওয়া হতে পারে তাহলে বর্তমানে সাতছড়িতে যে অস্ত্র চোরাচালান ধরা পড়লো তার জন্যও শেখ হাসিনার ফাসির দন্ড হতে পারে।
লক্ষনীয় যে ইতিপূর্বে হাসিনা যেমন জিয়াকে সম্মানসূচক “আপনি” সম্বোধন করেননি, ঠিক তেমনি, কুয়ালা লামপুরে হাসিনাকে “আপনি” সম্বোধন করেননি তারেক। বলা যায়, অনাকাংক্ষিত অশালীনতার ক্ষেত্রে এখন দুজনাই সমান পর্যায়ে নেমে এসেছেন - তবে অগ্রনী ভ’মিকার জন্য ক্রেডিট দাবি করতে পারবেন হাসিনা।
রাউন্ড ফোর
এই রচনাটি লেখা হচ্ছে তারেক-হাসিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতার রাউন্ড ফোর-এর প্রাক্কালে। লোকেশন ঢাকা। শনিবার ১৪ জুনে শেখ হাসিনা একটা প্রেস কনফারেন্সে বলবেন তার সদ্য সমাপ্ত চায়না টৃপ বিষয়ে। অনুমান করা যায় সেখানে হয়তো তিনি মুজিব-জিয়া বিতর্ক সম্পর্কে মন্তব্য করবেন। আর রবিবার ১৫ জুন ২০১৪-তে ইনজিনিয়ার্স ইন্সটিটিউশনে তারেক রহমান সম্পাদিত “জিয়াউর রহমান, বাংলাদেশের প্রথম প্রেসিডেন্ট ও স্বাধীনতার ঘোষক” শীর্ষক বইটির প্রকাশনা উৎসব হবে। এই বইতে তারেক লিখেছেন, “লন্ডনে প্রতিটি বক্তব্যের সঙ্গে আমি দালিলিক প্রমাণও উপস্থাপন করেছিলাম। আর এই সব দলিল প্রমাণ মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ইতহাস থেকে নেয়া। এখন আমি আরো একটি কথা বলতে চই। সেটি হলো শেখ মুজিব শুধু স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হিসেবেই অবৈধ নন; বরং ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি রাষ্ট্রপতি হিসেবেও ছিলেন অবৈধ। কারণ কোনো পাকিস্তানের নাগরিক বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হতে পারেন না। বাস্তবতা হলো, বাংলাদেশ শত্রুমুক্ত হয় ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসে আর তার ২৫ দিন পর তিনি গ্রহণ করলেন পাকিস্তানের পাসপোর্ট। এই বিষয়টি ইতিহাস বিচার করবে যুক্তি দিয়ে, আবেগ দিয়ে নয়। পাকিস্তানের পাসপোর্ট গ্রহণ করার পর আইনের দৃষ্টিতে এবং যুক্তিবুদ্ধির বিচারেও শেখ মুজিব তখন পাকিস্তানের নাগরিক। অতএব, বাংলাদেশে ফিরে তার প্রথম এবং প্রধান কাজটি হওয়ার কথা ছিল আইনগতভাবে যথানিয়মে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব গ্রহণ করা। শেখ মুজিব কি তা করেছিলেন? ইতিহাসে গোজামিলের কোনো সুযোগ নেই।”
এই প্রকাশনা উৎসবে প্রধান অতিথি বিএনপি নেতা মি. তরিকুল ইসলাম ও সভাপতি প্রফেসর ড. এমাজউদ্দীন আহমেদ নিশ্চয়ই এই বির্তক আরো এগিয়ে নিয়ে যাবেন। এই বইটির প্ল্যানিং, এডিটিং ও ডিজাইন হয়েছে লন্ডনে এবং সার্বিকভাবে বইটি উচু মানের হয়েছে। আশা করা যায় বিএনপি এই বইটির বহুল প্রচারে কাজ করবে।
কিন্তু আওয়ামী লীগ ও বিএনপি এবং পুরো রাজনৈতিক মহলে সেই একই প্রশ্ন ঘুরপাক খেতে থাকবে। তারেক রহমান এখন কেন শেখ মুজিবের কর্মকান্ডের মূল্যায়ন করছেন?
এই প্রশ্নটি নিশ্চয়ই শেখ হাসিনার মনেও আসছে।
যদি এই একটি প্রশ্ন শেখ হাসিনা তার মোবাইল ফোন করেন তারেক রহমানকে?
যদি তার উত্তরে তারেক রহমান মোবাইল ফোনে ১০ট প্রশ্ন করেন শেখ হাসিনাকে?
তখন কি কথা হবে?
রাউন্ড ফাইভ
যে একটি প্রশ্ন তারেক রহমানকে করতে পারেন শেখ হাসিনা:
১ আপনি এর আগে কখনোই হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর নামে কোনো কটু কথা বলেননি। এখন হঠাৎ কেন আপনি দেশে ও বিদেশে অত্যন্ত আপত্তিকর ও অবমাননাকর কথা বলছেন বঙ্গবন্ধুর নামে?
রাউন্ড সিক্স
যে ১০টি প্রশ্ন তারেক রহমান করতে পারেন শেখ হাসিনাকে:
১ একথা ঠিক যে আপনার প্রয়াত পিতা শেখ মুজিবুর রহমানকে সমালোচনা ও নিন্দার বহু সঙ্গত ও যৌক্তিক কারন সত্ত্বেও কখনোই আমার প্রয়াত পিতা তার (মুজিবের) প্রতি কোনো দিনো কোনো অশ্রদ্ধা ও অসম্মান প্রকাশ করেন নি। তার (জিয়ার) রাজনৈতিক উত্তরাধিকারী আমার মা হবার পর তিনিও কখনোই শেখ মুজিবের প্রতি অশ্রদ্ধা ও অসম্মান প্রকাশ করেননি। এমনকি কোনো ব্যক্তিগত আলোচনাতেও তিনি (মা) তা করেন না। 
পিতা ও মাতার এই সভ্য ও শালীন চরিত্রকে আমি অনুসরণ করার চেষ্টা সবসময়ই করেছি। আমার মা ১৯৯১-এর পরে এবং আমি ২০০১-এর পরে টুংগিপাড়ায় গিয়ে তার (মুজিবের) সমাধিস্থলে শ্রদ্ধা নিবেদন করেছি। কিন্তু আমাদের পরিবারের এই ভদ্রতা, সৌজন্যতা ও শালীনতা আপনি উপেক্ষা করেছেন। বরং ১৯৯৬-এ ক্ষমতাসীন হবার পরে মিথ্যা অজুহাতে জিয়ার সমাধিস্থলে যাবার বেইলি বৃজটি সরিয়ে ফেলেন। আমাদের পারিবারিক গুনাবলিকে আপনি আমাদের দাসত্ব, দুর্বলতা ও আনুগত্যের (মুজিবের প্রতি) চিহ্ন স্বরূপ ভেবেছেন। আপনি ভেবেছেন মুজিব হত্যায় সংশ্লিষ্ট থাকায় জিয়া তার অপরাধবোধ থেকে মুজিবের প্রতি শ্রদ্ধাবনত থেকেছেন। আপনি বোধ হয় আমার এবং আমার সম্পর্কে সেই একই কথা ভেবেছেন। 
আসলে সত্যটি তা নয়। আমার পিতা ও মার পারিবারিক ঐতিহ্য, সংস্কৃতি এবং সচ্ছলতা আমাদের সভ্য রীতিনীতির দিকে রেখেছে। কিন্তু আপনার এবং আপনার দলের অবিরাম প্রচারের ফলে কিছু সাধারণ মানুষ বিভ্রান্ত হয়েছে। এমনকি বিএনপিরও কিছু নেতা-কর্মীও  বিভ্রান্ত হয়েছেন। তারা মনে করেছেন আমার পিতা-মাতা এবং আমারই মতো, শেখ মুজিবকে সব বিতর্কের ঊর্ধে রেখে রাজনীতি করতে হবে।
তাই অনেকে আওয়ামী লীগের সমালোচনা করার সময়ে শেখ মুজিবের ব্যর্থতা উল্লেখ করেন না। তারা ভাবেন, এর ফলে তাদের প্রতি আপনার ব্যক্তিগত আক্রোশ হবে কম। ফলে তাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগে মামলা হবে কম। ফলে তাদের হয়রানি হবে কম। এবং মুজিব প্রসঙ্গে আওয়ামী বুদ্ধিজীবী ও সুশীল সমাজের সঙ্গে বিনা বিতর্কে তারা একই কাতারে থাকতে পারবেন।
কিন্তু তারা এটা বুঝতে পারেননি যে, যে মুহুর্তে শেখ মুজিবকে বিতর্কের ঊর্ধে নিয়ে তাকে একটি কল্পিত ও অসত্য অবস্থানে প্রতিষ্ঠিত করা হয় সেই মুহুর্তেই আওয়ামী বিরোধী রাজনীতিও অসম্ভব হয়। কারণ, শেখ মুজিব যদি বিতর্কের ঊর্ধে থাকেন, তাহলে, তার সম্পর্কে বহু প্রশ্ন অমীমাংসিত থেকে যায়। যেমন, ২৩ মার্চ ১৯৭১ পর্যন্ত তিনি কি আলোচনা করেছিলেন ইয়াহিয়া খান ও জুলফিকার আলি ভুট্টোর সঙ্গে? কেন তিনি তাজউদ্দীন আহমেদের উপদেশ অনুরোধ উপেক্ষা করে ২৫ মার্চ ১৯৭১-এ পাকিস্তানি আর্মির কাছে আত্মসমর্পন করলেন? কেন ১৯৭৪-এ দুর্ভিক্ষ হলো? কেন তিনি এক দলীয় শাসন চালু করলেন? কেন তিনি একনায়কে রূপান্তরিত হলেন? এসব প্রশ্ন আলোচিত হলেই বোঝা যাবে শেখ মুজিব তার শেষ জীবনে কতোটা ব্যর্থ পলিটিশিয়ান হয়েছিলেন। তার ব্যর্থতার ফলে দেশে যে শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছিল সেটা পূরণে ইতিহাস ঠেলে দিয়েছিল জিয়াকে। সময়ের চাহিদা জিয়া পূরণ করেছিলেন। তিনি সফল পলিটিশিয়ান এবং সফল প্রশাসক হয়েছিলেন।
আওয়ামী লীগের সমস্যাটা হয়েছে সেখানে। জিয়া যদি সফল ও ভালো হয় তাহলে মুজিবের ব্যর্থতা ও মন্দ দিকগুলো প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। সুতরাং সকল সত্য অস্বীকার করে মুজিবকে সফল ও ভালো রূপে চিত্রিত ও প্রতিষ্ঠিত করতেই হবে। পাশাপাশি জিয়াকে পাকিস্তানি গুপ্তচর ও মন্দ বলতে হবে। (যদিও মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময়ে এবং তারপরেও শেখ মুজিব ছিলেন পাকিস্তানে।) সেক্ষেত্রে মুজিবকে অপসরনকারী সবাই, মুজিবের পরে জিয়া ও অন্য যারা ক্ষমতায় এসেছেন তারা সবাই (আওয়ামী লীগের বাদে) এবং মুজিবের দল আওয়ামী লীগ বিরোধী সবাইকে বাংলাদেশের শত্রু বলা যাবে এবং সকল বিরোধী দলকে নিশ্চিহ্ন করা ন্যায়সঙ্গত হবে।
আমি এই সত্যটা বুঝতে পেরেছি। বুঝতে পেরেছি দেশকে বাচানোর লক্ষ্যে আওয়ামী লীগের এই মুজিব কার্ডটা চিরকালের জন্য সরিয়ে ফেলতে হবে। তাই শেখ মুজিব সম্পর্কে যা সত্য সেটাই বলতে হবে। সেটাই যথেষ্ট। শেখ মুজিবের ব্যর্থতা ও মন্দ কাজগুলো মানুষকে জানালে তারা বুঝতে পারবে আমার পিতা কতোটা সফল ও ভালো ছিলেন এবং তার মৃত্যুর পরে আমার মা-র নেতৃত্বে বিএনপি কতোটা ভালো কাজ করেছে।
আর এজন্যই বাধ্য হয়ে এখন আপনার পিতার কর্মকান্ডের মুল্যায়ন ও বিবরণ দেশবাসীর সামনে আমি তুলে ধরছি। আশা করি এতে আপনি মাইন্ড করবেন না। আপনি নিশ্চয়ই স্বীকার করবেন, আপনার পিতাকে প্রতিষ্ঠিত করার অধিকার যেমন আপনার আছে, তেমনই আমার পিতাকে প্রতিষ্ঠিত করার অধিকার আমারও আছে বিশেষত যখন আমার পিতা আপনাদের মিথ্যা প্রচারের শিকার হচ্ছেন। আপনি চরম দু:সাহস দেখিয়ে বলেছেন, আমার পিতা বেচে থাকলে তাকে আসামি করে বিচার করতেন। আমি কি একটু এগিয়ে গিয়ে বলতে পারি, আপনার পিতার মরণোত্তর বিচার আমি করব অন্তত একটি কারণে এবং সেটা হলো ১৯৭৪-এ দুর্ভিক্ষে এত মানুষের মৃত্যু হবার জন্য? আমার প্রথম প্রশ্ন এটি। আপনি এ বিষয়ে কি বলবেন?
২ আপনি ১৯৭৫ থেকে ১৯৮১ পর্যন্ত ইনডিয়াতে নতুন দিল্লিতে ছিলেন। আমার পিতা আপনাকে, আপনার স্বামী ও বোনকে ঢাকায় ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করেছিলেন। কিন্তু তখন আপনি ফিরলেন কেন? আপনি তো বিদেশে থাকতেই পছন্দ করেন। আপনার পিতার মৃত্যুর সময়ে বিদেশে জার্মানিতে ছিলেন। আপনি প্রধানমন্ত্রিত্বের প্রথম মেয়াদে পাচ বছরের মধ্যে প্রায় এক বছর বিদেশে ছিলেন। এখন ড. দীপুমনির বদলে আপনি বিদেশ চষে বেড়াচ্ছেন। আপনার ছেলে, মেয়ে, বোন, সবাই তো বিদেশে। কেন ১৯৮১ তে স্বদেশে ফিরেছিলেন এবং কেনই বা এখন স্থায়ীভাবে বিদেশে থাকতে চলে যাচ্ছেন না?
৩ আপনি বলেছেন, “জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন ও আমেরিকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি আপনাকে ফোন করে ফাসি (কাদের মোল্লাকে) না দিতে বলেছিলেন। একই অনুরোধ জানিয়ে অনেকে ফোন করেছিলেন। দেশে এমন কোনো লোক আছে যে এ ফোন পাওয়ার পর এ সাহস দেখাতে পারে? আমি বঙ্গবন্ধুর কন্যা বলেই সাহস দেখাতে পেরেছি।” 
ওয়ান ইলেভেনে মইনুদ্দিন-ফখরুদ্দিনের ক্যু-র পরে আপনার সাহস কোথায় ছিল? আমার মা যখন একটানা বন্দি জীবন যাপন করছিলেন তখন আপনি কেন মইন-ফখরুল সঙ্গে সমঝোতা করে দুই বার বাংলাদেশ ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন? আপনার স্মরণশক্তি ভালো। তবুও আপনাকে মনে করিয়ে দিচ্ছি। আমার মা ১১ সেপ্টেম্বর ২০০৮-এ জেলমুক্ত হবার প্রায় দুই মাস পরে ৬ নভেম্বর ২০০৮-এ আপনি আমেরিকার নিরাপদ জীবন থেকে দেশে ফিরে এসেছিলেন। আসলে আপনার সাহস নেই। যা আছে তা হলো ইনডিয়ার আশীর্বাদ এবং সেটাকে আপনি সাহস ভেবে আত্মপ্রসাদে ভোগেন।
প্রসঙ্গত একটি প্রশ্ন করতে চাই। বান কি মুন ও জন কেরির ফোনের কথা জনসম্মুখে প্রকাশ করাটা কি কূটনৈতিক শিষ্টাচার বহিভর্’ত হয়নি?
৪ সাহস প্রসঙ্গে আমি আরেকটি প্রশ্ন করতে চাই। ৩০ মে ১৯৮১-তে আমার পিতার মৃত্যুর পরে আপনি বোরকা পরে পালিয়ে যাবার চেষ্টা করেছিলেন কেন?
৫ আপনি প্রায়ই আমার মা এবং আমার ব্যক্তিগত জীবন প্রসঙ্গে গুজণের ভিত্তিতে কুরুচিপূর্ণ কটাক্ষ করেন কেন? আমরা তো সত্যের ভিত্তিতে প্রশ্ন করতে পারি আপনার স্বামী আপনাকে ছেড়ে বঙ্গভবনে দীর্ঘ সময়ের জন্য আশ্রয় নিয়েছিলেন কেন?
৬ সাভারে রানা প্লাজায় সরকারি হিসাবে প্রায় দেড় হাজার (বেসরকারি হিসাবে অনেক বেশি) গার্মেন্টস শ্রমিকের মর্মান্তিক মৃত্যুর পরে ঘটনাস্থলে গিয়ে সমবেদনা প্রকাশ করতে আপনার ছয় দিন দেরি হয়েছিল কেন? পিতা ও নিজের পরিবারের কারো মৃত্যু ছাড়া অন্য কারো অকালমৃত্যু কি আপনাকে নাড়া দেয়? শাপলা চত্বরে মে ২০১৩-তে ধর্মভীরু মানুষগুলোর মৃুত্যর পর  আপনি তাদের নিয়ে বিদ্রƒপ করলেন কেন?
৭ দিল্লিতে ২০১০-এ সম্পাদিত চুক্তিটি কেন বাংলাদেশের সংসদে আলোচিত হয়নি?
৮ গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠাতা নোবেল বিজয়ী ড. ইউনূসকে কেন অশ্রাব্য ভাষায় আপনি সমালোচনা করেছিলেন? এটা কি সত্যি যে বিদেশে আপনাকে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়েছিল আপনি সেই দেশের প্রধানমন্ত্রী যে দেশে থাকেন ড. ইউনূস।
৯ বিদেশিদের সম্মাননা জানানোর জন্য সোনার পদকে জালিয়াতি বিষয়ে আপনি বলেন, “স্বর্ণকার তো মায়ের গহনাও চুরি করে। আমরা তো সম্মাননা দিয়েছি। এখানে সোনার তো বড় বিষয় নয়। ... এই সম্মাননাকে প্রশ্নবিদ্ধ করার জন্য কেউ এটি করেছে কিনা এটিও দেখতে হবে।” চোর, ডাকাত, জালিয়াতদের পাশে দাড়ানো আপনার স্বভাবসিদ্ধ কেন?
১০ বিদেশিদের সম্মাননা দিচ্ছেন। কিন্তু আমার প্রশ্ন কেন দেশি বিচারপতিদের অসম্মান করছেন? নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের ঘটনায় র‌্যাবের সাবেক তিন কর্মকর্তাকে গ্রেফতারের বিষয়ে আদালতের নির্দেশের প্রসঙ্গ টেনে আপনি বলেছেন, “জজ অর্ডার দিলেন। তদন্ত চলাকালে ওই বেঞ্চ তাদের গ্রেফতারের অর্ডার দিল। আমরা এক-পা এগোতে পারি না। কেউ কেউ দুই তিন পা এগিয়ে যান। এতে সমস্যা সৃষ্টি হয়। তারা যে অর্ডার দিলেন, নিশ্চয়ই তাদের কাছে তথ্য আছে। এখন তথ্য চাইলে জজদের কাছে যান। তারা তথ্য দিলে সহযোগিতা হবে। ... কি? কনটেম্পট করবে? আমি পরোয়া করি না। আমার কথা কঠোর হয়ে যাচ্ছে? বাস্তব কথা কঠোরই হয়।”
আমিও এখন আপনার ভাষাতেই বলে আজ বিদায় নিতে চাই, আমার কথা কঠোর হয়ে যাচ্ছে? বাস্তব কথা কঠোরই হয়। 
১৪ জুন ২০১৪ shafik rahman

প্রচ্ছদ বাংলাদেশ সংবাদ ৬৫ বছরে অন্য এক আ.লীগ

আজ ২৩ জুন। আওয়ামী লীগের ৬৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী এই দলটি ৬৫ বছরের মাথায় এসে একতরফা নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা ধরে রেখে দেশে-বিদেশে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েছে৷ অথচ এই আওয়ামী লীগই পাঁচ বছর আগে ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর নির্বাচনে বিপুল বিজয়ের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় এসেছিল৷
একই সঙ্গে পরিণত হয়েছে অনেকটাই ব্যক্তিকেন্দ্রিক দলে। ঐতিহ্যবাহী এই দলের সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও দলীয় কর্মসূচি আবর্তিত হচ্ছে মূলত প্রধানমন্ত্রী ও দলীয় প্রধান শেখ হাসিনাকে কেন্দ্র করে। তিনি ৩৩ বছর ধরে আওয়ামী লীগের সভানেত্রী পদে রয়েছেন৷
১৯৪৯ সালের ২৩ জুন পুরান ঢাকার কে এম দাস লেনে অবস্থিত রোজ গার্ডেনে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সমর্থক নেতা-কর্মীদের এক বৈঠকে আত্মপ্রকাশ করে নতুন রাজনৈতিক দল আওয়ামী মুসলিম লীগ। তখন দলটির সভাপতি নির্বাচিত হন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী এবং শামসুল হক হন সাধারণ সম্পাদক। যুগ্ম সম্পাদকের দায়িত্ব পান শেখ মুজিবুর রহমান। পরবর্তী সময়ে দলের নাম থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে অসাম্প্রদায়িক ও গণমানুষের দল হিসেবে বিস্তার ঘটে আওয়ামী লীগের। সত্তরের নির্বাচনে বাঙালি জাতি আওয়ামী লীগের পক্ষে নিরঙ্কুশ রায় দেয়। এই দলটির নেতৃত্বে ১৯৭১ সালে পরিচালিত হয় মুক্তিযুদ্ধ।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে এবং ৩ নভেম্বর জাতীয় চার নেতাকে হত্যার পর বিপর্যয়ে পড়ে আওয়ামী লীগ৷ ১৯৮১ সালের ১৭ মে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দলের সভাপতি নির্বাচিত হন। এরপর প্রতিবার সম্মেলনেই তিনি সভাপতি নির্বাচিত হয়ে আসছেন।
১৯৮৭ সালে তৎকালীন স্বৈরশাসক এরশাদের বিরুদ্ধে সংগঠিত গণতন্ত্র রক্ষার আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে আওয়ামী লীগ। এরপর ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে প্রথম ক্ষমতায় আসে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ৷ ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীন অনুষ্ঠিত নির্বাচনে বিপুলভাবে জয়লাভ করে আবার ক্ষমতায় আসে দলটি। তখন দলটিকে ঘিরে মানুষের মধ্যে সুশাসনের ব্যাপক প্রত্যাশা তৈরি হয়েছিল৷
পরবর্তীতে উচ্চ আদালতের রায়ের কথা বলে সংবিধান সংশোধন করে নির্বাচনকালীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাদ দেওয়া হয়। নির্দলীয় সরকারের দাবিতে আন্দোলনরত প্রধান বিরোধী দল বিএনপি ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বর্জন করে। জনপ্রিয়তা যাচাইয়ের চূড়ান্ত পরীক্ষা ছাড়াই গত ৫ জানুয়ারি কার্যত একতরফা নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা ধরে রেখে ব্যাপক বিতর্কের মুখে পড়েছে আওয়ামী লীগ।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীসহ কেন্দ্রীয় বেশ কয়েকজন নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এখন দলীয় ফোরামে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত গ্রহণের চর্চা খুব একটা নেই। আত্মসমালোচনা বা সরকারের কার্যক্রমের গঠনমূলক সমালোচনার কথা কেউ ভাবতে পারেন না৷ দলীয় নেতাদের যে একটা অংশ বক্তৃতা-বিবৃতিতে সক্রিয়, তাঁদের মূল উদ্দেশ্য দলীয় প্রধানের দৃষ্টি আকর্ষণ। তাঁদের বক্তব্য মূলত বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও তাঁর ছেলে তারেক রহমানকে কেন্দ্র করে।
আওয়ামী লীগের সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, গত দুই মাসে দলের সভাপতি শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে কার্যনির্বাহী সংসদের দুটি বৈঠক হয়েছে। একটি বৈঠকে দলের সাংসদদেরও ডাকা হয়। কিন্তু ওই সব বৈঠকে দেশের সর্বশেষ রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হয়নি। এমনকি নারায়ণগঞ্জের বহুল আলোচিত সাত খুন, ফেনীতে উপজেলা চেয়ারম্যানকে পুড়িয়ে হত্যা ও লক্ষ্মীপুরে খুনোখুনির বিষয় আলোচনায় স্থান পায়নি। কেন্দ্রীয় একাধিক নেতা জানান, নেতাদের প্রায় সবাই দলীয় প্রধানের মনোভাব বুঝে বক্তব্য দেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হারুন-অর-রশিদ প্রথম আলোকে বলেন, সেনাশাসন, বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা ও মৌলবাদী রাজনীতির কারণে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোতে গণতান্ত্রিক চর্চাটা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নেয়নি। তিনি মনে করেন, গণতান্ত্রিক চর্চা এখনো যা আছে, তা আওয়ামী লীগেই বিদ্যমান।
আওয়ামী লীগের উচ্চপর্যায়ের নেতাদের অনেকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নির্দিষ্ট সময়ে কেন্দ্রীয় কমিটির সম্মেলন হলেও ভোটাভুটির মাধ্যমে নেতৃত্ব নির্বাচনের চর্চা অনেক দিন ধরেই নেই৷ দলীয় সভানেত্রীর ইচ্ছা-অনিচ্ছাতেই নেতৃত্ব নির্বাচিত হয়।
ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের সম্মেলন হয়েছে এক বছর আগে। তাতে দলীয় প্রধানকে পূর্ণাঙ্গ কমিটি করার দায়িত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু এখনো কমিটি ঘোষণা করা হয়নি।
এ ছাড়া সারা দেশে ৭৩টি সাংগঠনিক জেলার মধ্যে ১৩টির হালনাগাদ কমিটি আছে। বাকিগুলোর কমিটি আটকে আছে স্থানীয়ভাবে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের কারণে। নারায়ণগঞ্জের বিতর্কিত নেতা শামীম ওসমানের অবস্থান দলে কী হবে, সেটা নিয়ে আটকে আছে ওই জেলার কমিটি।
সারা দেশে মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটিগুলো সম্মেলনের মাধ্যমে পুনর্গঠনের কথা ছিল। সম্প্রতি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের নেতৃত্বে দলের একটি সাংগঠনিক বৈঠকে রাজশাহী, খুলনা মহানগরসহ সাতটি জেলা কমিটির সম্মেলন করার সিদ্ধান্ত হয়। এর মধ্যে মুিন্সগঞ্জের সম্মেলন হয়েছে গত শনিবার। তাতে পুরোনো নেতৃত্বই রয়ে গেছে। সাংগঠনিক কার্যক্রম বলতে এখন দিবসকেন্দ্রিক কর্মসূচিতেই সীমাবদ্ধ।
জানতে চাইলে প্রবীণ রাজনীতিক ও আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেন, আওয়ামী লীগের মূল ভিত্তি হচ্ছে জনসম্পৃক্ততা ও গণমুখিতা। মাছ যেমন পানি ছাড়া বাঁচতে পারে না, তেমনি জনগণ ছাড়া আওয়ামী লীগেরও অস্তিত্ব বিলীন। তিনি আরও বলেন, এখন সময় হচ্ছে সংবিধান রক্ষা, সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও জনগণকে সম্পৃক্ত করার।
প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর কর্মসূচি: প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে আজ সোমবার আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয় এবং দেশব্যাপী দলীয় কার্যালয়ে জাতীয় ও দলীয় পতাকা উত্তোলন করা হবে। সকাল সাতটায় ধানমন্ডির বঙ্গবন্ধু ভবনে জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ করা হবে। সোয়া সাতটায় বঙ্গবন্ধু ভবনে জাতীয় ও দলীয় পতাকা উত্তোলন, জাতীয় সংগীত পরিবেশন, পায়রা ও বেলুন ওড়ানো হবে। বেলা তিনটায় সোহরাওয়ার্দী উদ্যান থেকে বঙ্গবন্ধু ভবন পর্যন্ত গণশোভাযাত্রা। ২৮ জুন বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে হবে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আলোচনা সভা। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর কর্মসূচি সফল করার আহ্বান জানিয়েছেন।
প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে দলের সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক বাণীতে নেতা, কর্মী, সমর্থক ও শুভানুধ্যায়ীদের শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানিয়েছেন৷   prothom alo