বুধবার, ২৭ মার্চ, ২০১৩

ব্রিটিশবিরোধী বিপ্লবী চুনতির মাওলানা আবদুল হাকিম (শরীফ মুহাম্মদ)

ধারণা নিয়ে এসেছিলাম, চট্টগ্রাম শহর থেকে বেশি একটা দূরে নয়। বাস্তবে সেরকম হলো না। বহদ্দারহাট থেকে গাড়ি ছাড়ার পর দু’ঘণ্টার মাথায় এসে পৌঁছলাম। কক্সবাজারের পথে সাতকানিয়া-লোহাগাড়া বাসস্টপেজ পার হয়ে সামান্য এগুলেই বাঁদিকে চুনতি হাকিমিয়া কামিল মাদরাসার দেয়াল তীর। সে পথে ১০ মিনিট। দু’পাশে লাল মাটির টিলাটক্কর, তার ওপর বিছানো সবুজ ঘাস, দাঁড়ানো ধূসর বৃক্ষ। শহরের এত দূরে এত বড় ও প্রাচীন একটি ইসলামী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। আবাক হতে হয়! ১৮১০ সালে প্রতিষ্ঠিত এ ঐতিহ্যবাহী মাদরাসার যিনি মূল প্রতিষ্ঠাতা এবং পরবর্তী সময়ে যার নামে এই মাদরাসার নামকরণ, সেই অমর স্বাধীনতা সংগ্রামী ও সাধক আলেম মাওলানা আবদুল হাকিম সিদ্দিকী (রহ.)-এর স্মৃতির সন্ধানেই বিচিত্র সৌন্দর্য ও ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ এ গ্রামে আমাদের ছুটে আসা। পথে পথে সফল পথনির্দেশক সফরসঙ্গীর ভূমিকা ধৈর্যের সঙ্গে পালন করেছেন চট্টগ্রামের তরুণ আলেম-লেখক মুহাম্মাদ হাবীবুল্লাহ।
মাদরাসার বর্তমান প্রিন্সিপাল মাওলানা মুহাম্মদ হাফিজুল হক নিজামী আন্তরিকতার সঙ্গে আমাদের গ্রহণ করলেন। অফিসকক্ষে উপস্থিত চুনতির ১৯ দিনব্যাপী সিরাতুন্নবী (সা.) মাহফিলের প্রতিষ্ঠাতা মরহুম হাফেজ আহমদ শাহ সাহেবের এক যুবক নাতির সঙ্গে তিনি পরিচয় করিয়ে দিলেন। তার নাম আবদুল মালেক ইবনে দীনার নাজাত। গাজীয়ে বালাকোট মাওলানা আবদুল হাকিমের জীবনতথ্য সংবলিত বেশকিছু ম্যাগাজিন ও ডকুমেন্ট তুলে দিলেন প্রিন্সিপাল সাহেব। এর মধ্যে রয়েছে ‘আনজুমন’ ২০০ বছর পূর্তি সংখ্যা, উর্দুতে লেখা হাকিমিয়া মাদরাসার ১৯৬২ সালের রিপোর্টের কপি ও কম্পোজ করা একটি পরিচিতিপত্রের প্রথম পাতা। জীবনীর উপাত্ত অল্প সময় উল্টেপাল্টে দেখলাম। এর মধ্যেই তিনি এবং নাজাত আমাদের নিয়ে বের হলেন। উদ্দেশ্য প্রায়—বিস্মৃত এক স্বাধীনতা সংগ্রামী আলেমের কবর জিয়ারত ও তার বংশধরদের সঙ্গে সাক্ষাত্।

দুই.
মাওলানা আবদুল হাকিম ছিলেন গাজীয়ে বালাকোট। ব্রিটিশবিরোধী বিপ্লব ও সর্বভারতীয় জিহাদ আন্দোলনে তিনি পূর্ববঙ্গ থেকে যাওয়া অন্যতম যোদ্ধা। সংস্কার, সংগ্রাম ও শুদ্ধির সেই আন্দোলনের ইতিহাস নিয়ে লিখিত ভারত-পাকিস্তানের প্রামাণ্য বইপত্রে তার নাম রয়েছে। পূর্ববঙ্গ থেকে যাওয়া বিপ্লবীদের প্রসঙ্গ—আলোচনায় কখনও তার নাম এসেছে মিরসরাইয়ের সুফি নূর মুহাম্মদ নিজামপুরীর সঙ্গে, কখনও এসেছে ওই আন্দোলনে পূর্ববঙ্গের প্রধান ব্যক্তিত্ব গাজী ইমামুদ্দিন বাঙালির সঙ্গে। তার জন্ম-মৃত্যু তারিখ সংরক্ষিত না থাকলেও পূর্বাপর ঘটনাবলী থেকে সাব্যস্ত হয় যে, ১৮২২ সাল থেকে নিয়ে ১৮৩১ সালের আগে কোনো এক সময়ে তিনি জিহাদ আন্দোলনে যুক্ত হয়ে যান। একইসঙ্গে আন্দোলনের ইমাম সাইয়েদ আহমদ শহিদ (রহ.)-এর হাতে বায়াতও গ্রহণ করেন। বালাকোট ও তার আগের কয়েকটি যুদ্ধে তিনি বীর বিক্রমে লড়াই করেন। তার হাতে চুনতিতে ১৮১০ সালে হাকিমিয়া মাদরাসা প্রতিষ্ঠার তথ্য থেকে বোঝা যায়, অন্তত ১৭৯০ সালের আগে জন্মগ্রহণ করেছেন তিনি। তিনি নিজ পরিবার, চট্টগ্রাম শহর ও কলকাতা মাদরাসায় লেখাপড়া করেন। নিজ গ্রামে মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করে শিক্ষকতা করেন। হায়দরাবাদের শহীদ টিপু সুলতানের ছেলে শুকুর উল্লাহর পরিবারে পারিবারিক শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। চট্টগ্রাম শহরে মুনসেফ পদেও কিছুদিন চাকরি করেন। ১৮২২ সালের পর জিহাদ ও সংগ্রামের ডাক এলে সবকিছু ছেড়ে তিনি বিপ্লবী কাফেলার সঙ্গে সীমান্ত প্রদেশের দিকে চলে যান। ১৮৩১ সালে বালাকোট বিপর্যয়ের পর তিনি আবার চট্টগ্রামে ফিরে আসেন। বাকি জীবন মুসলিম সমাজ থেকে কুসংস্কার দূর করা, ইসলামী শিক্ষা বিস্তার এবং ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রামের নানা আয়োজন ও সংগঠনে কাজ করে যান। সুদূর আরব থেকে আসা সচ্ছল ও অভিজাত এক খান্দানের সন্তান মাওলানা আবদুল হাকিম ব্রিটিশ ফিরিঙ্গীদের কবল থেকে দেশকে মুক্ত করা এবং ধর্মরক্ষার সংগ্রামে প্রাণের মায়া ত্যাগ করে রণক্ষেত্রে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। কোনো কোনো সূত্রে উল্লেখ করা হয়েছে, তিনি ছিলেন ইসলামের প্রথম খলিফা হজরত আবু বকর সিদ্দিক (র.)-এর ৩৯তম বংশধর। বিভিন্ন ঘটনায় তার পূর্বপুরুষরা আরব থেকে পর্যায়ক্রমে বাগদাদ, লাহোর ও গৌড় হয়ে চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে এসে বসতি গড়েন। সেখান থেকে তার পিতামহ এসে ওঠেন চুনতিতে। তখন থেকে এখন পর্যন্ত তার পরিবারের বসতি এই চুনতিতেই। চুনতির সিদ্দিকী পরিবার বলতে মানুষ তার পরিবারকেই চিনত। পরবর্তী সময়ে তার ছোট ভাই ডেপুটি কালেক্টর মরহুম মৌলভি নাসির উদ্দিনের বংশধরদের ডেপুটি পরিবার এবং তার অধস্তনদের বসতি বড় মাওলানা বা বড় মৌলভি সাহেবেরপাড়া নামে পরিচয় লাভ করেছে। সরাসরি তার সন্তান এবং সন্তানদের সন্তানরা প্রায় সবাই ধর্মীয় কিংবা আধুনিক শিক্ষায় উচ্চশিক্ষিত। সিদ্দিকী পরিবারসহ চুনতির বিখ্যাত কাজী পরিবার, সিকদার পরিবার, মিরজী পরিবার, শুকুর আলী মুন্সেফ পরিবার, মুন্সি পরিবার, দারোগা পরিবার এবং বুড়া মৌলভি সাহেবের পরিবারের লোকেরা সাধারণভাবে শিক্ষিত ও ধর্মপ্রাণ এবং নানাস্তরে বৈবাহিক সূত্রে প্রায় প্রতিটি পরিবারই আরেকটি পরিবারের সঙ্গে যুক্ত।

তিন.
প্রথমেই সিদ্দিকী পরিবারের গোরস্তান। সামান্য উঁচু টিলা। নাক বরাবর মাথায় একটি মসজিদ। সিঁড়ি দিয়ে ওঠার পরই হাতের বাঁদিকে একটি ঘরের মতো। ভেতরে দুটি কবর। শুয়ে আছেন দু’ভাই। পশ্চিম দিকে বুজুর্গ-সাধক ও বিপ্লবী পুরুষ মাওলানা আবদুল হাকিম (রহ.)। পূর্বদিকে ছোট ভাই ডেপুটি কালেক্টর মৌলভি নাসির উদ্দিন। দাঁড়িয়ে জিয়ারত করলাম। বিভিন্ন কবরের নামফলক থেকে বোঝা গেল, দু’ভাইয়ের বংশধরদের অনেকেই এখানে শুয়ে আছেন। একদম শান্ত-ছায়াঘেরা একটি পরিবেশ। এ দেশের কোনো গ্রামে গোরস্তানের এতটা পরিপাটি চেহারা খুব কমই চোখে পড়ে। এরপরই আমাদের নিয়ে যাওয়া হলো ‘বড় মৌলভি সাহেবের পাড়ায়’। প্রিন্সিপাল সাহেব দরজায় কড়া নাড়তেই বের হলেন আবদুল হাকিমের চতুর্থ প্রজন্মের এক বংশধর—জয়নুল আবেদীন সিদ্দিকী (৭৫)। তিনি আমাদের ভেতরে নিয়ে বসালেন। চুনতির এই বর্ষীয়ান মানুষটির গায়ে নিবেদিত এক আলেম-বিপ্লবীর রক্ত বইছে। তার মুখোমুখি বসে কথা বললাম। তিনি বললেন, আমি শুনলাম। প্রাপ্ত লিখিত তথ্যের বাইরে তিনি তার পরদাদা সম্পর্কে কিছু বলতে পারলেন না। তবে তার ডাকে ছুটে এলেন তারই এক ভাতিজা আনসারুল আজিম। তিনিও বৃদ্ধ। নিজের খাতায় লেখা তাদের বংশলতিকার একটি চিত্র আমাদের হাতে তিনি দিলেন। আর দিলেন হাকিমিয়া মাদরাসার সাবেক শিক্ষক মরহুম মীর গোলাম মোস্তফার উর্দুুুুুুুুতে লেখা একটি চিঠি। সে চিঠিতে রয়েছে জিহাদ আন্দোলন, সাইয়েদ আহমদ শহিদ এবং মাওলানা আবদুল হাকিম সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত একটি বর্ণনা। ওই চিঠির ফটোকপি নিয়ে এলাম। ফেরার সময় আবার মাদরাসায়। সেখানে দেখা হলো মাদরাসার ব্যবস্থাপনা কমিটির প্রবীণ সদস্য মাওলানা নাসিরুদ্দিনের সঙ্গে। তিনিও আবেগ ও স্মৃতি মিশিয়ে কিছু কথা বললেন।
দুপুরে আপ্যায়নের আন্তরিক আহ্বানে সাড়া দিতে না পারায় অস্বস্তি হচ্ছিল। রোদ মাথায় নিয়ে বের হলাম। চালকের আসনে বসা মুরাদ। চট্টগ্রামের উদ্দেশে আবার ছুটল গাড়ি। আমার কাজের প্রতি মমতাবান খালিদ মামা ঢাকায় বসেই গাড়িটির ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। অল্প সময়ের মধ্যেই ফিরে যেতে পারছি। ফিরে যাওয়ার সময় এবার মনে হলো, রাজধানী থেকে এত দূরবর্তী একটি গ্রাম ও ইউনিয়নের বুকে এত ঐতিহ্য, ইতিহাস, শিক্ষা ও ধর্মপ্রাণতার সমন্বিত দৃষ্টান্ত সম্ভবত এ দেশে খুবই কম। সমৃদ্ধ এই চুনতিরই সন্তান মাওলানা আবদুল হাকিম। এই বিপ্লবী আলেম ও সংগ্রামী দরবেশের জন্মভিটা ও সমাধি-বাগানটিও সমৃদ্ধ ছোট্ট এই জনপদের এক বিশেষ ঐতিহ্য-সম্পদ। আমাদের জন্মভূমির স্বাধীনতার অচর্চিত ইতিহাসে এ সম্পদের নীরব প্রাচুর্যের মূল্য অনেক। গাড়ির চাকায় ভর করে কেবল নগর কোলাহলের দিকে সবাই ধাবমান। পেছনে পড়ে থাকে নীরব, গভীর অমূল্য প্রাচুর্যের ভাণ্ডার। সে ভাণ্ডার একটু থেমেও দেখতে চাই না। এভাবেই প্রজন্ম পার হতে হতেই আমরা নিঃস্ব হয়ে যাই।(২৮ মার্চ ১৩’ তারিখের দৈ
নিক আমার দেশ থেকে সংকলিত)

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন